পণ্ডশ্রম
শামসুর রাহমান
এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।
যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে,
পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে।
সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।
মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?
নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।
ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।
শামসুর রাহমানের 'পণ্ডশ্রম' কবিতার মূলভাব হলো, জীবনে অনেক পরিশ্রম বা প্রচেষ্টা অর্থহীন বা নিষ্ফল হয়, যা কোনো সুফল বয়ে আনে না। কবিতাটি এমন এক ব্যর্থ পরিশ্রমের প্রতি ইঙ্গিত করে, যা সত্ত্বেও কোনো ফল পাওয়া যায় না এবং এই নিষ্ফল শ্রমের প্রতি এক ব্যঙ্গাত্মক সুর ফুটে উঠেছে। মানুষ অনেক সময় ভুল পথে ছুটতে থাকে, ভেবে নেয় তার আসল জিনিসটা বাইরে কোথাও হারিয়ে গেছে। অথচ যা খুঁজছে, তা তার কাছেই থাকে। যেমন এখানে “চিল কান নিয়ে গেছে” ভেবে সবাই হাহাকার করছে, মাঠে-বিলে খুঁজছে, মিটিং করছে। শেষে দেখা গেল কান তো আসলে নিজের জায়গাতেই আছে।
অর্থাৎ, অযথা ভ্রান্ত ধারণা আর গুজবের পেছনে ছুটে কষ্ট করা বৃথা। সত্য অনেক সময় খুব সহজ, আমাদের চোখের সামনেই থাকে।
শামসুর রাহমানের জীবনী
বাংলা আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান। তাঁর কবিতা শুধু শব্দের কারুকার্য নয়, বরং সমাজ, সময়, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম ও মুক্তির প্রতিচ্ছবি। তিনি ছিলেন কাব্যভুবনের “মুক্তবুদ্ধির কণ্ঠস্বর”—যিনি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবতা এবং প্রেমকে একসাথে ধারণ করেছেন।
জন্ম ও শৈশব
শামসুর রাহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে। তাঁর পিতার নাম শামসুর রাহমান চৌধুরী এবং মাতার নাম আমেনা খাতুন। তিনি ছিলেন পিতামাতার চতুর্থ সন্তান।
শৈশবে তিনি ছিলেন নীরব, কৌতূহলী এবং স্বভাবত অন্তর্মুখী। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। কবিতা আবৃত্তি ও লেখা তিনি কৈশোরকালেই শুরু করেন।
শিক্ষা জীবন
প্রথমে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন ঢাকার নবাবপুর সরকারি বিদ্যালয়ে। এরপর
১৯৪৫ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।
১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেন।
উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রথমে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
সাহিত্য জীবনের সূচনা
১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক “সায়েন্স” পত্রিকায় প্রকাশিত হয় শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা। তবে তাঁর প্রকৃত সাহিত্যজীবনের সূচনা হয় ১৯৫৭ সালে, যখন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে” প্রকাশিত হয়।
এই গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতায় নতুন ধারা সূচনা করেন।
কবিতার বিষয়বস্তু ও বৈশিষ্ট্য
শামসুর রাহমানের কবিতায় প্রেম, মানবতা, প্রকৃতি, স্বাধীনতা, সংগ্রাম এবং আধুনিক শহুরে জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।
স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ : তাঁর কবিতায় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লেখা কবিতা “স্বাধীনতা তুমি” স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠে।
প্রেম ও মানবিকতা : তিনি ছিলেন একাধারে প্রেমের কবি। তাঁর কবিতায় প্রেম এসেছে একদিকে রোমান্টিক রূপে, আবার অন্যদিকে সামাজিক দায়বদ্ধতার সাথে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা : স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর কবিতা প্রতিবাদ ও অনুপ্রেরণার ভাষা হয়ে ওঠে।
উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ
শামসুর রাহমান প্রায় ৬০টিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৫৭)
রৌদ্র করোটিতে (১৯৬০)
বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২)
নিজ বাসভূমে (১৯৭৪)
দুঃসময় ও অন্যান্য কবিতা
দানিয়াবাড়ীর ঘোড়া
উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ
মহাদুঃসময়ের কবিতা
তাঁর কবিতাগুলো মুক্তচিন্তা, স্বাধীনতা ও মানবতার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে।
সাংবাদিকতা ও কর্মজীবন
কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতায় বাস্তবতাকে গভীর করেছে।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
শামসুর রাহমান তাঁর কাব্যকীর্তির জন্য অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৯)
একুশে পদক (১৯৭৭)
স্বদেশি পুরস্কার
আদমজী সাহিত্য পুরস্কার
স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯১)
ব্যক্তিজীবন
শামসুর রাহমান ১৯৫৫ সালে সাইদা রাহমানকে বিয়ে করেন। সংসারজীবনে তিনি ছিলেন শান্ত, নীরব এবং সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন।
মৃত্যু
বাংলা কবিতার এই উজ্জ্বল নক্ষত্র ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় এবং পরবর্তীতে তাঁকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
উত্তরাধিকার
শামসুর রাহমান ছিলেন গণমানুষের কবি। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। তাঁর কবিতা তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবতার পথে চলতে অনুপ্রাণিত করে। তিনি কেবল কবি নন, ছিলেন সময়ের সাক্ষী এবং সমাজের কণ্ঠস্বর।
কান নিয়েছে চিলে, Bangla Rhymes, Bangla Kobita, Bangla Funny Poem, Bangla Kids Rhymes, Bangla Abriti, Bengali Funny Poem, বাংলা ছড়া, শিশুদের কবিতা, Kids Poem Bangla
#কাননিয়েছেচিলে #BanglaRhymes #BanglaKidsPoem #BanglaKobita
Информация по комментариям в разработке