Скачать или смотреть গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ

বাঙালি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিএবং জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হচ্ছে নৌকা। আর সেই নৌকাকে কেন্দ্র করে এবং নৌকা চালানোর কৌশলের উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, যেটা মূলত নৌকা বাইচ নামে পরিচিত।

নদীর বুকে এক অন্যরকম লড়াই, যেখানে শুধু সাহস আর কৌশলের জয়য় হয়।
বর্ষাকালে নদীমাতৃক বাংলাদেশে যখন খাল-বিল পানিতে ভরে ওঠে, তখন নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয়।
এটি একটি প্রাচীন লোকজ ঐতিহ্য এবং মোঘল আমল থেকেই শহরাঞ্চলে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়য়। বর্তমানে বাংলাদেশের উত্তর পশ্চামন্চল বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও পনচগড় বা দিনাজপুরে নৌকা বাইচ জনপ্রিয় না হলেও দেশের পূরবন্চল বা হওড় অন্চলে এখনো নৌকা বাইচ এর ঐতিহ্য টিকে আছে এবং, জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর এই নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয়।তো আজকের ভিডিওতে নৌকা বাইচ সম্পকে বিস্তারিত তুলে ধরবো
নৌকা বাইচ
নৌকাবাইচ হলো মূলত নদীতে নৌকা চালনার প্রতিযোগিতা। তবে এখানে দাঁড় টানার কসরত ও নৌকা চালনার কৌশল দ্বারা বিজয় লাভের লক্ষ্যে যে প্রতিযোগিতা। একদল মাঝি নিয়ে একেকটি দল গঠিত হয়। এমন অনেকগুলো দলের মধ্যে নৌকা চালনা প্রতিযোগিতাই হলো নৌকা বাইচ।।

ইতিহাস
কবে এদেশে গণবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নৌকাবাইচের প্রচলন হয়েছিলো তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। "বাইচ" শব্দটির ব্যুৎপত্তি বিবেচনা করে অনুমন করা হয় যে মধ্যযুগের মুসলমান নবাব, সুবেদার, ভূস্বামীরা, তাদের নৌবাহিনী, তারা এই প্রতিযোগিতামূলক বিনোদনের সূত্রপাত করেছিলেন
এ বিষয়ে দুটি পেক্ষাপট জানা যায়।
একটি হলো জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রাকে কেন্দ্র করে। আরেকটি হলো পীরগাজীকে কেন্দ্র করে। জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার সময় বহু নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লা-যাত্রীরা প্রতিযোগিতার আনন্দ পায়। এ থেকে কালক্রমে নৌকাবাইচের শুরু। আরেকটি হলো আঠারো শতকের শুরুর দিকে কোনো এক গাজী পীর মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড়ে থাকা তা ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন। কিন্তু ঘাটে কোন নৌকা ছিলো না। ভক্তরা তার কাছে আসতে একটি ডিঙ্গি নৌকা খুঁজে বের করেন। যখনই নৌকাটি মাঝ নদীতে পৌছায়, তখনই নদী ফুলে ফেঁপে উঠে। তখন চারপাশের যত নৌকা ছিলো তারা খবর পেয়ে সারিবদ্ধ হয়ে একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে আসে। এ থেকেই নৌকা বাইচের গোড়াপত্তন হয়।[২]
মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের আমলে নৌকা বাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিলো। অনেকে মনে করে নবাব বাদশাহদের নৌ বাহিনী থেকেই নৌকা বাইচের গোড়াপত্তন হয়। পূর্ববঙ্গের ভাটি অঞ্চলের রাজ্য জয় ও রাজ্য রক্ষার অন্যতম কৌশল ছিল নৌ শক্তি। বাংলার বারো ভূঁইয়ারা নৌ বলেই মোগলদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। মগ ও হার্মাদ জলদস্যুদের দমনে নৌ শক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এসব রণবহর বা নৌবহরে দীর্ঘাকৃতির ছিপ জাতীয় নৌকা থাকতো।

বাইচে ব্যবহৃত নৌকার গঠন
সম্পাদনা
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকা দেখা যায়। বাইচের নৌকার গঠন কিছুটা ব্যাতিক্রম। এই নৌকা হয় সরু ও লম্বাটে।লম্বায় প্রায় ১৫০ ফুট থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত হয় সরু ও লম্বাটে হওয়ার কারণে নদীর পানি কেটে দ্রুত চলতে সক্ষম ।এর সামনের দিকটা পানির সাথে মিশে থাকে আর পেছনের অংশটি পানি থেকে প্রায় ৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। নৌকার সামনের গলুইটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। তাতে কখনো করা হয় ময়ূরের মুখ, কখনো রাজহাঁস বা অন্য কোনো পাখীর মুখাবয়ব। নৌকাটিতে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করে বিভিন্ন নকশা তৈরি করা হয়। সর্বোপরি নৌকাটিকে দর্শকের সামনে যথাসম্ভব আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা থাকে।।

বাইচে ব্যবহৃত নৌকার নাম
সম্পাদনা
বাইচের নৌকাগুলোর বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন, উড়ন্ত বলাকা, অগ্রদূত, ঝরের পাখি, পঙ্খিরাজ, ময়ূরপঙ্খী, সাইমুন, তুফান মেল, সোনার তরী, দীপরাজ ইত্যাদি


বাইচের নিয়ম বা আনুষ্ঠানিকতা
প্রতিটি নৌকায় ৭, ২৫, ৫০ বা ১০০ জন মাঝি থাকতে পারেন।[১]
উপযুক্ত নৌকায় দু’পাশে মাঝিরা সার বেধে বসে পড়ে বৈঠা হাতে। মাঝিদের বৈঠা টানাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য একজন পরিচালক থাকে যাকে বলা হয় গায়েন। সে বসবে নৌকার গলুই-এ। মাঝিরা একত্রে জয়ধ্বনি সহকারে নৌকা ছেড়ে দিয়েই এক সাথে কোনো একটি গান গাইতে আরম্ভ করে এবং সেই গানের তালের ঝোঁকে ঝোঁকে বৈঠা টানে; যার ফলে কারও বৈঠা ঠোকাঠুকি না-লেগে এক সাথে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। গায়েন বা পরিচালক কাঁসির শব্দে এই বৈঠার এবং গানের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলে নিজেদের নৌকাকে সবার আগে যাওয়ার চেষ্টায় প্রয়োজন বোধে কাঁসির শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয় এবং সেই সাথে গানের গতিও বেড়ে চলে। এ ছাড়া এই সময় দেহ ও মনের উত্তেজনার বশেই গানের মধ্যে 'হৈ, হৈয়া" এই ধরনের শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। এটি সারি গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা
সম্পাদনা
নৌকা বাইচকে উৎসাহ প্রদান ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার লক্ষে প্রতি বছর বাংলাদেশে জাতীয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে প্রধানত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার দূরত্ব ৬৫০ মিটার। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের নৌকা বাইচের উন্নয়নের জন্য ‘বাংলাদেশ রোয়িং ফেডারেশন’ গঠিত হয়। সনাতন নৌকা বাইচ ও রোয়িং এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই বাংলাদেশ রোয়িং ফেডারেশনের কাজ। এ ফেডারেশনটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রোয়িং ফেডারেশনের সদস্য। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে একটি আন্তর্জাতিক নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।[