গায়ত্রী মন্ত্র : হল বৈদিক হিন্দুধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বেদের অন্যান্য মন্ত্রের মতো গায়ত্রী মন্ত্রও "অপৌরষেয়" (অর্থাৎ, কোনো মানুষের দ্বারা রচিত নয়) এবং এক ব্রহ্মর্ষির কাছে (গায়ত্রী মন্ত্রের ক্ষেত্রে ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র) প্রকাশিত। এই মন্ত্রটি বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত। এটি ঋগ্বেদের (মণ্ডল ৩।৬২।১০) একটি সূক্ত। গায়ত্রী মন্ত্র গায়ত্রী ছন্দে রচিত।[১] হিন্দুধর্মে গায়ত্রী মন্ত্র ও এই মন্ত্রে উল্লিখিত দেবতাকে অভিন্ন জ্ঞান করা হয়। তাই এই মন্ত্রের দেবীর নামও গায়ত্রী। গায়ত্রী মন্ত্র দিয়ে শুধু পূজাই হয় না, গায়ত্রী মন্ত্রকেও পূজা করা হয়।
দেবীরূপে গায়ত্রী মন্ত্র
গায়ত্রী মন্ত্র দিয়ে হিন্দু দেবতা সবিতৃকে আবাহন করা হয়। তাই গায়ত্রী মন্ত্রের অন্য নাম "সাবিত্রী মন্ত্র"।[২] সাবিত্রীর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা অনুসারে এই মন্ত্র সূর্যপূজা, যোগ, তন্ত্র বা শাক্তধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
মন্ত্রটির শুরুতে ওঁ-কার এবং "মহাব্যাহৃতি" নামে পরিচিত "ভূর্ভুবঃ স্বঃ" শব্দবন্ধটি পাওয়া যায়। এই শব্দবন্ধটি তিনটি শব্দের সমষ্টি - ভূঃ, ভূবঃ ও স্বঃ। এই তিনটি শব্দ দ্বারা তিন জগতকে বোঝায়। ভূঃ বলতে বোঝায় মর্ত্যলোক, ভূবঃ বলতে বোঝায় স্বর্গলোক এবং স্বঃ হল স্বর্গ ও মর্ত্যের সংযোগরক্ষাকারী এক লোক। বেদে যে সপ্তভূমি বা সাত জগতের উল্লেখ আছে, এগুলি তার মধ্যে তিনটি জগতের নাম। ধ্যান অনুশীলনের ক্ষেত্রে ভূঃ, ভূবঃ ও স্বঃ - এই তিন লোক চেতন, অর্ধচেতন ও অচেতন - এই তিন স্তরের প্রতীক।
বৈদিক সাহিত্যে বহুবার গায়ত্রী মন্ত্র উল্লিখিত হয়েছে।[৩] মনুস্মৃতি,[৪] হরিবংশ,[৫] ও ভগবদ্গীতায়[৬][৭] গায়ত্রী মন্ত্রের প্রশংসা করা হয়েছে। হিন্দুধর্মে উপনয়ন সংস্কারের সময় গায়ত্রী দীক্ষা একটি প্রধান অনুষ্ঠান এবং হিন্দু দ্বিজ সম্প্রদায়ভুক্তেরা এই মন্ত্র নিত্য জপ করেন। আধুনিক হিন্দু ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে গায়ত্রী মন্ত্র নারী ও সকল বর্ণের মধ্যে প্রচলিত হয়েছে।[৮][৯]
এই ফাইলটি শুনতে অসুবিধা হচ্ছে? দেবনাগরী হরফে গায়ত্রী মন্ত্রবাংলা প্রতিলিপিকরণ
ॐ भूर्भुवः स्वः ।
तत्स॑वितुर्वरे॑ण्यं ।
भर्गो॑ देवस्य॑ धीमहि। ।
धियो यो नः॑ प्रचोदया॑त्॥ ।[১০]
ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ
তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।।
গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণের আগে ওঁ-কার উচ্চারণ করা হয়। তারপর "মহাব্যাহৃতি" নামে পরিচিত "ভূর্ভূবঃ স্বঃ" শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করা হয়। তৈত্তিরীয় আরণ্যক (২। ১১। ১-৮) অনুযায়ী, ধর্মগ্রন্থ পাঠের আগে ওঁ-কার, মহাব্যাহৃতি ও গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়।[১১] মহাব্যাহৃতির পরে ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলে উক্ত (৬২।১০) মূল মন্ত্রটি পাঠ করা হয়।
এই মন্ত্র জপ করার সঠিক সময়
- গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার প্রথম সময়টি সকাল। মন্ত্রটি সূর্যোদয়ের একটু আগে জপ শুরু করা উচিত এবং সূর্যোদয়ের পরে জপ করা উচিত। মন্ত্র জপ করার জন্য দ্বিতীয় সময় হল দুপুর। ... সূর্যাস্তের আগে আপনার মন্ত্র জপ করা শুরু করা উচিত এবং সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পরে জপ করা উচিত
গায়ত্রী ছন্দে আটটি শব্দাংশ-যুক্ত মোট তিনটি পাদ থাকে। কিন্তু ঋগ্বেদ সংহিতায় উল্লিখিত গায়ত্রী মন্ত্রে একটি শব্দাংশ কম। এই মন্ত্রের প্রথম পাদে সাতটি শব্দাংশ। তাই তিন-শব্দাংশযুক্ত "বরেণ্যং" শব্দের পরিবর্তে "বরেণীয়ং" শব্দটির দ্বারা শব্দাংশের সংখ্যায় সমতা আনা হয়।[১২]
গায়ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র হিসাবে বিবেচিত হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এই মন্ত্রটি জপ করে ঈশ্বর প্রাপ্ত হয়। গায়ত্রীর ধ্যানে আছে, তিনি সূর্যমণ্ডলের মধ্যস্থানে অবস্থানকারিনী, বিষ্ণু বা শিবরূপা, হংসস্থিতা বা গরুড়াসনা বা বৃষবাহনা। তিনি একাধারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব।
হিন্দু বিধান অনুসারে, সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় গায়ত্রী ধ্যান করতে হয় এবং এই মন্ত্র ধ্যান বা পাঠে মুক্তি প্রাপ্ত হয় বলে এর নাম ‘গায়ত্রী’। বেদজ্ঞ আচার্যের কাছে এই মন্ত্রে দীক্ষিত হলে তার পূণর্জন্ম হয় ও তিনি দ্বিজ নামে আখ্যাত হন। সেই কারণে দ্বিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণগণের উপাস্য। বৈদিক গায়ত্রী মন্ত্রে আদলেই অন্যান্য দেবতার গায়ত্রী রচিত হয়েছে, দ্রষ্টব্য গণেশ, কালী, গুহ্যকালী, নারায়ণ, রাধা প্রভৃতি ।
মনে করা হয় এই মন্ত্র জপ করলে ১) উত্সাহ এবং ইতিবাচকতা বৃদ্ধি, ২) মন ধর্ম এবং সেবার কাজে নিযুক্ত থাকে ৩) ভবিষ্যদ্বাণী শুরু হয় ৪) প্রার্থণা করার শক্তি বৃদ্ধি পায়, ৫) স্বপ্ন সাধনা হয়, ৬) ক্রোধ শান্ত হয় ৭) মনকে কাবু করার ক্ষমতা তৈরি হয়।
গায়ত্রী মন্ত্র এবং এর অর্থ হল, আমাদের ঈশ্বরকে সেই প্রাণ, দুঃখ, আনন্দদায়ক, শ্রেষ্ঠ, গৌরবময়, পাপী, ঈশ্বরের মতো রূপ হিসাবে রাখা উচিত। ঈশ্বর আমাদের বুদ্ধি জীবন পথে অনুপ্রাণিত করে। এই মন্ত্র জপ করার সঠিক সময় - গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার প্রথম সময়টি সকাল। মন্ত্রটি সূর্যোদয়ের একটু আগে জপ শুরু করা উচিত এবং সূর্যোদয়ের পরে জপ করা উচিত। মন্ত্র জপ করার জন্য দ্বিতীয় সময় হল দুপুর। এই মন্ত্রটি জপ করা হয় বিকেলেও। তৃতীয় সময় হল সন্ধ্যা। সূর্যাস্তের আগে আপনার মন্ত্র জপ করা শুরু করা উচিত এবং সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পরে জপ করা উচিত। যদি আপনি গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে চান তবে তা নিঃশব্দে বা মানসিকভাবে করা উচিত। মন্ত্র উচ্চারণ করা উচিত নয়।
Информация по комментариям в разработке