আব্বাসিয় খেলাফতের সময় বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অর্থনৈতিক উৎকর্ষতার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। বিজ্ঞানচর্চায় তাদের অর্থায়নের অন্যতম উদাহরণ বাগদাদের বিখ্যাত লাইব্রেরি, বাইতুল হিকমাহ, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় হাউজ অব উইজডম। পঞ্চম শতকের আশপাশ থেকে অন্তত নবম শতক পর্যন্ত এই লাইব্রেরির সংগ্রহ ছিল বিশ্বে সবথেকে বড়। এর অঙ্গন সর্বদা মুখরিত থাকত তৎকালীন বড় বড় পন্ডিতদের ভিড়ে।
বায়তুল হিকমাহ’র ধারণার সূচনা হয় বাগদাদ প্রতিষ্ঠার সময়। আব্বাসিয়দের দ্বিতীয় খলিফা, আল-মনসুর এখানে রাজধানী সরিয়ে আনেন। উদ্দেশ্য ছিল দামেস্ক কেন্দ্রিক উমাইয়াদের প্রভাব একেবারে মুছে ফেলা। এই অঞ্চলে ইসলামি শক্তি সাসানিদদের প্রতিস্থাপন করে। তবে তাদের প্রভাব রয়ে গিয়েছিল আব্বাসিয় দরবারে। ফলে পুরনো সাম্রাজ্যের অনেক রীতিনীতি রয়ে যায়। সাসানিদ অভিজাতেরা বই জমা রাখার জন্য ঘর বানাতো, যার নাম ganj। আরবিতে এর প্রতিশব্দ খিজানাহ । আল-মনসুর বাগদাদে তেমন কিছু করতে চাইলেন।
খলিফা আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি থেকেও অনুপ্রাণিত হন। তার ইচ্ছে বাগদাদে এমন একটি সংগ্রহ গড়ে তোলা যার নাম হবে খিজানাত আল-হিকমাহ। ৭৭৫ সালে মারা যান তিনি। তার স্বপ্ন সত্যি করেন খলিফা হারুন আল-রশিদ । ৭৮৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই রাজদরবারের লাইব্রেরির একাংশ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন তিনি। উজির ইয়াহইয়া আল-বারমাকির ওপর দায়িত্ব পরে বড় পরিসরে লাইব্রেরি তৈরি করার।
প্রাথমিক পর্যায়ে খলিফার দাদা এবং বাবার কাছে থাকা শিল্পসাহিত্য আর বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ের ঠাঁই হয় লাইব্রেরিতে। পারস্যের উপকথা, সাসানিয়ান জ্যোতির্বিদদের লেখনি ইত্যাদি আরবিতে অনুবাদ করা হয়। এজন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন অনুবাদক এবং বই বাঁধাইকারকেরা। এই পর্যায়ে অবশ্য প্রাচীন পারস্যভাষার গ্রন্থই কেবল আরবিতে অনুবাদ হয়েছিল।
হারুন আল-রশিদের পুত্র পরবর্তী খলিফা আল-মামুনের সময় এই পাঠাগার চূড়ান্ত উৎকর্ষ অর্জন করে। ৮১৩ থেকে ৮৩৩ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন আল-মামুন। মূল ভবনকে পরিবর্ধিত করে তিনি একটি অ্যাকাডেমি স্থাপন করেন, এর নামই হয় বাইতুল হিকমাহ । ৮২৯ সালে আল-মামুন এখানে একটি মানমন্দিরও বানিয়ে দেন।
সংগ্রহশালা বাড়াতেও নানা পদক্ষেপ নেন খলিফা। কিংবদন্তী আছে সিসিলির রাজকীয় লাইব্রেরির পুরোটাই নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তৎকালীন বিশ্বে বিজ্ঞান আর গণিতের উঁচুমানের কিছু লেখনি ছিল সেখানে। আল-মামুন মূলত সেগুলো কপি করতে চেয়েছিলেন। এই ব্যাপারে সিসিলিতে বার্তা পাঠান তিনি। রাজা তার উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ করেন। তাদের মতামত ছিল গ্রন্থাগারের এসব বই তাদের পূর্বপুরুষদের কোনো উপকারে আসেনি, এগুলো দিয়ে দেয়াই ভাল। রাজা এরপর খলিফাকে সম্পূর্ণ লাইব্রেরিই দিয়ে দেন। বলা হয় ৪০০ উট লেগেছিল সমস্ত বই নিয়ে আসতে।
বাইতুল হিকমাহ’র সাথে জড়িয়ে আছে বহু দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর কাহিনী। এদের অন্যতম মুসা আল-খাওয়ারিজমি । একাধারে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে পারদর্শী এই ব্যক্তি বীজগণিতের জনক বলে অভিহিত। জাতে পারসিক আল-খাওয়ারিজমি ভূগোল, গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে রচনা করেছেন অনেক মূল্যবান পুস্তক। ৮২০ সালে তাকে লাইব্রেরির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
বাইতুল হিকমাহর নিয়মিত দর্শনার্থীদের মধ্যে আরো ছিলেন বনু মুসা ভ্রাতৃত্রয়- মুহাম্মদ, আহমাদ এবং হাসান। গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের নানা শাখায় ছিল তাদের পদচারণা। যন্ত্র-প্রকৌশল বা মেকানিক্সের বিকাশে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বাইতুল হিকমাহ’র অন্যতম একটি কাজ ছিল বিজ্ঞানের বই গ্রীক, সংস্কৃত, ল্যাটিন ইত্যাদি ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদ করা। লা হয় এই কাজকে প্রণোদনা দিতে চমকপ্রদ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন খলিফা আল-মামুন- অনুবাদকৃত বইয়ের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ দেয়া হবে অনুবাদককে।
গ্রীক পন্ডিতদের অনেক লেখা আরবিতে তর্জমা করা হয়েছিল। পিথাগোরাস, প্লাটো, অ্যারিস্টোটল, হিপোক্র্যাটস, গ্যালেন, সক্রেটিস, ইউক্লিড কেউ বাদ যাননি। আল-কিন্দি জড়িত ছিলেন অ্যারিস্টোটলের অনুবাদকর্মে, হুনায়ুন ইবন ইশহাক করেছিলেন হিপোক্র্যাটসের ভাষান্তর । আরো অনেক প্রসিদ্ধ অনুবাদকের লেখা জমা ছিল বাইতুল হিকমাহতে। উল্লেখযোগ্য হলেন আল-বাতরিক , হাজ্জাজ ইবন মাতের , আল-বুলবাকি, থাবিত ইবন-কুরাহ এবং আরো অনেকে।
সংস্কৃত থেকে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গ্রন্থ ভাষান্তরে বাইতুল হিকমাহ’র অবদান অনেক। এর ফলেই আরব গণিতবিদেরা শুন্যের ধারণা নিয়ে কাজ করার সুযোগ পান। সংখ্যা বোঝাতে ভারতে আলাদা চিহ্ন ব্যবহার করা হতো। এর উন্নয়ন ঘটিয়ে বর্তমান আরবি সংখ্যাপদ্ধতির প্রচলন হয়। এই বাইতুল হিকমাহতে বসেই আল জাহিজ নানারকম প্রাণীর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে রচনা করেছিলেন বিখ্যাত ‘The Book of Animals’। আল-মালিক নির্ণয় করেছিলেন এমন পরিমাপ যা ব্যবহার করে পৃথিবীর পরিধি নির্ধারণ করেছিলেন ভবিষ্যৎ জ্যোতির্বিদরা।
Tag:
আমাদের পৃথিবী, বাগদাদ নগরীর ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, অবিস্মরণীয় সেই লাইব্রেরি, BAITUL HIKMAH, BAGHDAD, বাইতুল হিকমাহ, বাইতুল হিকমাহ লাইব্রেরী, baitul hikmah baghdad, baitul hikmah, hikmah baghdad, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লাইব্রেরী, সর্ববৃহৎ লাইব্রেরী বাইতুল হিকমাহ, বাইতুল হিকমা, বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ লাইব্রেরী, বাগদাদ নগরী ধ্বংসের ইতিহাস, বাগদাদ শহর, বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, বাগদাদ নগরী ধ্বংসের কারণ, বাগদাদ, বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ,আব্বাসী খিলাফতের পতন, বাগদাদের লাইব্রেরি,
Информация по комментариям в разработке