#Sundarbans #mangrove
সুন্দরবন: প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের আধার
সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকার ব-দ্বীপ অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় বিস্তৃত। প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই বনের ৬৬% (৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার) বাংলাদেশে এবং বাকি ৩৪% ভারতে অবস্থিত। এটি বিশ্বের বৃহত্তম অখণ্ড ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে পরিচিত।
১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশ অংশ ‘সুন্দরবন’ এবং ভারতীয় অংশ ‘সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান’ নামে তালিকাভুক্ত। ১৯৯২ সালে এটি রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে, ২০২০ সালে আইইউসিএন মূল্যায়নে ভারতীয় সুন্দরবনকে বিপন্ন ইকোসিস্টেম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বনের ৩১.১% এলাকা নদী, খাঁড়ি ও জলাভূমি নিয়ে গঠিত, যা এর বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্রের প্রমাণ।
সুন্দরবন তার অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। এখানে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমির, সাপ, ২৯০ প্রজাতির পাখি, ১২০ প্রজাতির মাছ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮টি উভচর প্রজাতি। সাম্প্রতিক জরিপে প্রায় ১০৬ বাঘ এবং ১,০০,০০০-১,৫০,০০০ চিত্রা হরিণের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। প্রধান উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, গোলপাতা। সুন্দরী গাছ এই বনের নামকরণের মূল উৎস।
সুন্দরবন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট হুমকির সম্মুখীন। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর ৪০% বন ক্ষতিগ্রস্ত করে, এবং ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় ১,০০,০০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, স্বাদুপানির হ্রাস ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি বনের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করছে। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো শিল্প প্রকল্প বনের জন্য হুমকি। অবৈধ শিকার ও বন উজাড় জীববৈচিত্র্য হ্রাস করছে।
‘সুন্দরবন’ নামটি সম্ভবত সুন্দরী গাছ থেকে এসেছে, তবে ‘সমুদ্র বন’ বা ‘চন্দ্র-বান্ধে’ থেকেও হতে পারে। স্থানীয়ভাবে এটি ‘বাদা’, ‘হুলোবন’ বা ‘মহাল’ নামে পরিচিত। মুঘল আমলে সুন্দরবনের ইজারা নিয়ন্ত্রিত হতো। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর মানচিত্র তৈরি করে, এবং ১৮৭৮ সালে এটি সংরক্ষিত বন ঘোষিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাংলাদেশ অংশে বনের ৬৬% পড়ে।
সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি কাঠ, মধু, মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা সরবরাহ করে। বনটি উপকূলীয় অঞ্চলকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে। প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এই বনের উপর জীবিকার জন্য নির্ভরশীল। পর্যটন একটি সম্ভাবনাময় খাত, যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন।
বাংলাদেশ ও ভারত সরকার বন সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালে খুলনা বন সার্কেল গঠিত হয়, এবং ভারতে বন অধিদপ্তর জাতীয় উদ্যান পরিচালনা করে। তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য—সুন্দরবন পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম—বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত। অবৈধ শিকার নিষিদ্ধ, তবে জীববৈচিত্র্য হ্রাস উদ্বেগজনক।
সুন্দরবন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বৃহত্তম আবাসস্থল। ২০০৪ সালে এখানে প্রায় ৫০০ বাঘ ছিল, বর্তমানে সংখ্যা ১০৬-এ নেমেছে। বাঘের আক্রমণে প্রতি বছর ১০০-২৫০ মানুষের মৃত্যু হয়। স্থানীয়রা বনবিবির পূজা, মুখোশ ও গলায় প্যাড ব্যবহার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
সুন্দরবনের নদী ও খাঁড়িতে প্রায় ৩০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, যার মধ্যে ১২০টি বাণিজ্যিক গুরুত্ব বহন করে। তবে, অতিরিক্ত মাছ ধরা, বিষ প্রয়োগ ও চিংড়ি চাষের ফলে মাছের প্রাচুর্য কমছে। ইলিশ, পারশে, ভোল, কাইক্কা মাছ বিরল হয়ে পড়ছে।
একসময় সুন্দরবনে জলদস্যুদের উৎপাত ছিল মারাত্মক। ২০১২ সালে গঠিত টাস্কফোর্স এবং ২০১৬-২০১৮ সালে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রায় ৪০০ বছরের দস্যুতার অবসান ঘটে, যা বনের নিরাপত্তা ও পর্যটন বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণের অমূল্য সম্পদ। জলবায়ু পরিবর্তন, শিল্পায়ন ও মানবিক কার্যকলাপের কারণে এর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। সুন্দরবন রক্ষায় সমন্বিত সংরক্ষণ প্রচেষ্টা ও স্থানীয় সচেতনতা জরুরি। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
Информация по комментариям в разработке