একসময় যেই দিক দিয়ে বড় বড় পালতোলা নৌকা ও লঞ্চ চলত । জেলেরা বিভিন্ন দেশীয় জাতের মাছ ধরে তাদের জীবিকা নিরবাহ করতো । পাওয়া যেত সকল দেশীয় জাতের মাছ | নৌকা বাইচ যখন ছিল প্রত্যেক বছরের আনন্দের নতুন মাত্রা । এখন ময়লার ডাস্টবিন আর নালায় পরিণত হয়েছে, আমার চোখে দেখা শুভাঢ্যা খাল। এমনটাই বলছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বয়সী এক বৃদ্ধ |
ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার আগানগর এলাকার বাসিন্দা নিতাই মন্ডল তিনি জানান, ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা খালটি একটি ঐতিহ্যবাহী খাল। উপজেলার শুভাঢ্যা, আগানগর ও তেঘরিয়া ইউনিয়নের প্রায় ৫০ গ্রামের মানুষের সুপেয় পানির প্রধান উৎসও ছিল এটি। এটি এক সময় কেরানীগঞ্জের মানুষের গর্ব ছিল। তবে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ খালে পরিণত হয়েছে। তাই এ খালটি এখন কেরানীগঞ্জবাসীর জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রায় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ খালের প্রায় অর্ধেকই পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়।
আগানগর ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা খালটি বাঁচাতে সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, চরকালিগঞ্জ, কালিগঞ্জ বাজার, জোড়া ব্রিজ, নয়া শুভাঢ্যা, কদমতলী, চরকুতুব, ঝাউবাড়ি, বেগুনবাড়ি, গোলামবাজার এলাকায় গার্মেন্টসের টুকরো কাপড়, ময়লা আবর্জনা ও গৃহস্থালির বর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে। এসব অংশে হারিয়ে যাচ্ছে খালের অস্তিত্ব। এছাড়া কালিগঞ্জ জোড়া ব্রিজ থেকে কৈবর্ত্য পাড়া পর্যন্ত খালের জায়গা দখল করে অনেকেই বাড়ি-ঘর নির্মাণ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আগানগর ও শুভাঢ্যা খালের একাধিক বাসিন্দা জানান, কিছু অসাধু লোক খালের নামে বছর বছর বরাদ্দ এনে লোক দেখানো কিছু কাজ করে। বাকি টাকায় কী করা হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে একমাত্র তারাই জানেন। বর্ষা মৌসুমে যখন এখানে পানি আসে তখন খাল উদ্ধারে বিভিন্ন মহল এগিয়ে আসে। অথচ শুকনো মৌসুমে খালের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।
স্থানীয়দের দাবি, খালের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। জনগণের আইওয়াশের জন্য কিছু কাজ করেই পরবর্তী সময়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সরেজমিনে আরও দেখা যায়, এসব এলাকায় শত শত বাড়িঘর, গার্মেন্টস ও দোকানপাট গড়ে ওঠায় এসব এলাকার মানুষজন তাদের প্রতিদিনের বর্জ্য খালেই ফেলছে। বিভিন্ন ওয়াশিং ও ডাইং কারখানার বর্জ্য মিশে খালের পানি কালো রঙ ধারণ করেছে।
এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ পোশাক ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক নজরুল ইসলাম তিনি জানান, ‘খালটিতে যাতে পোশাকশিল্পের ময়লা, আবর্জনা ফেলা না হয় সেজন্য সমিতির পক্ষ থেকে কারখানা মালিকদের বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, খালের আশপাশের ঘরবাড়িগুলোর ড্রেনের সুয়ারেজ লাইন থাকার কারণে সেখান থেকে বর্জ্য এসে খালের সংযোগ শাখাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। পানির প্রবাহ চলমান রাখতে এই শাখাগুলো উদ্ধার করা প্রয়োজন। ঐতিহ্যবাহী এ শুভাঢ্যা খালের শাখাগুলো হচ্ছে খেজুরবাগ খাল, কবুতরপাড়া খাল, কদমতলী খাল, জেলেপাড়া খাল, কালীগঞ্জ খালসহ আরও কয়েকটি; যা বর্তমানে দখল ও ময়লার ভাগারের কারণে ভরাট হয়ে আছে।
এদিকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা খাল ও খালের পাড় সুরক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য ২০০৭ সালে এক হাজার ২৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্খনন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০১২ সালে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল খালের অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা ফের চালু করা হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্য খালের পাড়ে বিনোদনমূলক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি। তিন বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের পুরো অর্থই সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হওয়ার কথা ছিল।
প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে আরও জানা যায়, প্রকল্পের মূল কাজ ছিল ১৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার স্লাস অপসারণ, ২ দশমিক ৬ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, ২ দশমিক শূণ্য ৮ কিলোমিটার খালের পাড় সংরক্ষণ এবং ৬১ দশমিক ৯৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ। পাশাপাশি ভাসমান ও সমতলে চলার পথ ২২ দশমিক ৬৭৩ কিলোমিটার, পাঁচটি পয়ঃডাইভারশন স্ট্রাইকার নির্মাণ, ওয়াকওয়ে ও সেতু লাইটিং, মাঠঘাট ও হাট উন্নয়ন, খাল পাড়ে বিদ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন, প্লাজা নির্মাণ ছয়টি এবং পরামর্শক নিয়োগ। কিন্তু সরেজমিনে এর কোনো কিছুই দেখা যায়নি।
জানা গেছে, ২০১২ সালে বর্ষার সময় শুভাঢ্যা খালের শাখা চুনকুটিয়া ও কালিবাড়ি খালের উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই মাত্র ছয় মাস পরেই বন্ধ হয়ে যায়। শুভাঢ্যা খালে কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষেপসহ খালের পাড়ে অবৈধভাবে বাড়িঘর, দোকানপাট, কলকারখানা ও মসজিদ গড়ে উঠেছে। ফলে খালটির প্রস্থ ও গভীরতা কমে গেছে। নিষ্কাশিত বর্জ্যরে কারণে খালের পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এছাড়া খালের দুই পাড়ের মানুষগুলো জায়গা দখল করায় খালটির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হতে চলেছে।
পূর্ব আগানগর গুদারাঘাটের খেয়া নৌকার মাঝি রহিম বখস বলেন, ‘এই খালে এক সময় নৌকা চালাইয়্যা আমি রোজগার করতাম। এই খাল দিয়ে গোলামবাজার হয়ে যাত্রী নিয়্যা রাজেন্দ্রপুর বাজারে যাইতাম। খাল এমনভাবে ভরাট হইছে যে, এহুন আর ঢোকাই যায় না। তাই বাধ্য হয়ে আগানগর গুদারাঘাট থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত যাত্রী পারাপার করছি।’
শুভাঢ্যা কালীবাড়ি এলাকার বাসিন্দা রঞ্জন দাস। তিনি বলেন, ‘এই খালটি আমাদের আশীর্বাদ ছিল। বড় বড় নৌযান এই খাল দিয়ে ধলেশ্বরী নদীতে যেত। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থায় নেই। ভরাট ও দূষণে খাল এখন মৃতপ্রায়। সরকার যদি এই খাল উদ্ধারে এগিয়ে আসে তাহলে এটি আবার প্রাণ ফিরে পাবে।’
ঢাকা ম্যাক আশা করে খালটির অবৈধ দখল, মাটি ভরাট, ভবন নির্মান, ময়লা ফেলা বন্ধ করার সাথ্বে সরকার এবং উল্লেখিত সংস্থা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করবেন |
Информация по комментариям в разработке