অষ্টাবক্র গীতা - নতুন সংস্করণ
অষ্টাবক্র গীতা অদ্বৈতবাদের একটি প্রাচীন গ্রন্থ। মহাভারতের রচনাকালেরও আগে এই অষ্টাবক্রমুনির জীবনকাল প্রবাহিত হয়েছিল। এমনও হতে পারে, মহাভারতকার ব্যাসদেবের সমসাময়িক বা বয়োবৃদ্ধ ছিলেন, এই অষ্টাবক্র মুনি। মহর্ষি ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেবের গুরু ছিলেন, ঋষি জনক। এই জনক নামের রাজা এক না একাধিক, তা বলা মুশকিল। এমনও হতে পারে, কোনো এক দেশের রাজার উপাধি ছিল, জনক অর্থাৎ পিতা। এই দেশের সমস্ত রাজাকেই বলা হতো জনক। তো কোনো এক জনক রাজার শিষ্য ছিলেন, ব্যাসপুত্র শুকদেব। আর রাজা জনকের গুরু ছিলেন, অষ্টাবক্র মুনি। অষ্টাবক্রের পিতা ছিলেন, ঋষি কহোড়। মাতা সুজাতা। মাতামহ ছিলেন, ঋষি উদ্দালক। আর মাতুল ছিলেন, শ্বেতকেতু।
যাইহোক, আমাদের উদ্দেশ্য স্রষ্টাকে জানা নয়, সৃষ্টিকে জানা । যদিও কথায় কথায় আমাদের তাদের কথা অবশ্যই আসবে, কিন্তু তা আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় নয়। তাই আমরা সরাসরি সৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করবো। অর্থাৎ অষ্টাবক্র গীতার মধ্যে প্রবেশ করবো।
অষ্টাবক্র গীতা আসলে, গুরুশিষ্যঃ সংবাদ। গুরু ঋষি অষ্টাবক্র, শিষ্য রাজা জনক। শিষ্য গুরুকে প্রশ্ন করছেন। হে গুরুদেব, আমার প্রভু, কিভাবে আমার তত্ত্বজ্ঞান লাভ হবে ? কিভাবেই বা আমার মুক্তি হবে ? কিভাবেই বা আমি বৈরাগ্য প্রাপ্ত হতে পারবো ?
সরাসরি প্রশ্ন দিয়ে, অষ্টাবক্র গীতার শুরু। এই প্রশ্ন একেবারে আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের প্রথম এবং শেষ প্রশ্ন। আমাদের সবার আকুল হৃদয়ের প্রশ্ন। আসলে সত্যিকারের জিজ্ঞাসুর মধ্যে প্রশ্ন জাগে। আর আমরা প্রশ্ন করি।
যাইহোক, রাজা জনক বলছেন,
কথম্ জ্ঞানম অবাপ্নোতি – জ্ঞান লাভের উপায় বলুন ।
কথম্ মুক্তির্ভবিষ্যতি – মুক্তি কি ভাবে হবে ?
বৈরাগ্যং চ কথম্ প্রাপ্তম – বৈরাগ্য-ই বা কি ভাবে প্রাপ্ত হয় ?
এতদ্ ব্রূহি মম প্রভো – আমার প্রভু, এই সমস্ত আমাকে বলুন ।
সরাসরি আধ্যাত্মিক প্রশ্ন দিয়ে অষ্টাবক্র সংহিতার শুরু। কোনো ভূমিকা নয়। সরাসরি প্রশ্ন : ১) হে প্রভু,জ্ঞান কি করে লাভ করা যায় দয়া করে বলুন। ২) মুক্তি কী ভাবে হবে ? ৩) বৈরাগ্য কি ভাবে পাওয়া যায়।
ভগবৎ গীতা যাঁরা পড়েছেন, তারা দেখেছে, - অর্জুনই প্রথম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জ্ঞান দেওয়া শুরু করেছিল। প্রথমে তো আদেশ - "হে অচ্যুত ! উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন করো। " পরে কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে তা দেখে, তার মধ্যে মায়া, মমতা, স্নেহ, শ্রদ্ধা, প্রভৃতি কমনীয় গুনের জাগরণ ঘটে। অহিংস সাত্বিক ভাব জেগে ওঠে। হিংসা ছেড়ে, যুদ্ধ ছেড়ে - বৈরাগী হতে চাইলো। আর এর স্বপক্ষে নানান যুক্তি খাড়া করে, কৃষ্ণকে বোঝাতে চেষ্টা করলো। অর্জুনের আদৌ আধ্যাত্মিক জ্ঞান পাবার ইচ্ছেই ছিল না। তার জিজ্ঞাসার কোনো আধ্যাত্মিক দিকও নেই। অর্জুন কেবলমাত্র নিজের সাময়িক অহিংস-নীতির পক্ষে শ্রীকৃষ্ণের সমর্থন চাইছিলো।
আর ক্ষেত্রটাও যুদ্ধ-ক্ষেত্র। এখানে কোনো আধ্যাত্মিক আলোচনা চলতেই পারে না।
অন্যদিকে কঠোপনিষদ যেখানে আমাদের আত্মা সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য পাই, সেখানে দেখছি, গুরুদেব-এর কাছে, নচিকেতা নিজের ইচ্ছেতেও যায় নি। এমনকি সশরীরেও যমরাজের কাছে যেতে পারেনি। তার কোনো প্রশ্নও ছিলোনা। স্রেফ যমরাজ তিনটি বর দিতে চেয়েছিলো, তাই কি চাইবেন, কি চাইবেন ভেবে তিনটি বর প্রার্থনা করেছিল : ১) আমার পিতা যেন আমার সন্মন্ধে দুশ্চিন্তা না করেন - আমার প্রতি যেন তার রাগ না থাকে - আমি আবার মানুষ হিসেবে ফিরে গেলে যেন আমাকে সবাই চিনতে পারে। ২)স্বর্গ প্রাপ্তি - অর্থাৎ দুঃখহীন ভোগের রাজত্বে যাবার রাস্তা বলে দাও। ৩) তিন নম্বর প্রশ্নটি ছিল আত্মার অস্তিত্ব - অনস্তিত্ব্য সম্পর্কে জ্ঞান। আসলে এই প্রশ্নটার জন্যই কঠোপনিষদ মান্যতা পেয়েছে। প্রথম প্রশ্ন দুটোতো একেবারেই ফালতু প্রশ্ন। তৃতীয় প্রশ্নে অধ্যাত্বিকতার ছোঁয়া থাকলেও যমরাজ নানান বাহানায় তাকে জবাব দিতে চাইছিলো না। নচিকেতাকে সে উপযুক্ত মনেই করছিলো না। যাক সে সব কথা -
মহারাজা জনক তিনটে প্রশ্ন করছেন। প্রথম প্রশ্ন - কথম জ্ঞানম ? কি ভাবে জ্ঞান হবে। হে প্রভু,জ্ঞান কি করে লাভ করা যায়, দয়া করে বলুন। দ্বিতীয় প্রশ্ন : মুক্তি কী ভাবে হবে ? তৃতীয় প্রশ্ন : বৈরাগ্য কি ভাবে পাওয়া যায়। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করে, আর সত্যিকারের জিজ্ঞাসুর মনে প্রশ্ন জাগে। আমরা সাধারণ মানুষ, অন্যকে অযাচিত অনেক উপদেশ থাকি, পরামর্শ দিয়ে থাকি। এটা ঠিক নয়, ওটা ঠিক। এটা করা উচিত, ওটা করা উচিত নয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। যেন আমরা সবজান্তা। আমরা অন্যের উপরে উপদেশের বোঝা চাপিয়ে দেই। কিন্তু নিজে যখন বিপদে পড়ি, তখন বিভ্রান্ত হয়ে যাই। আমরা প্রশ্ন করি, আমার সমর্থনে বক্তব্য শোনার জন্য। অন্যকে যাচাই করবার জন্য। এদের প্রশ্ন জ্ঞানের পিপাসা থেকে আসে না। আসে বেদনা থেকে, সমস্যা থেকে। আর এরা উত্তরের অপেক্ষায়ও না। উত্তর পেলেও সেই অনুযায়ী কাজ করে না। তাই এদেরকে এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। যাই হোক রাজার মনে প্রশ্ন জেগেছে। যা যথাযথ জ্ঞানের পিপাসা থেকে এসেছে।
রাজা জনক বলছেন, মুক্তি কিভাবে হবে ? অর্থাৎ রাজা জনক মুক্তির প্রত্যাশী। রাজা জনক ছিলেন, একজন স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজা। তো তাকে কে বেঁধে রেখেছে, যে তিনি মুক্তি চাইছেন ? আসলে আমরা যে বদ্ধজীব, আমাদের এই ধারণাই নেই। ,আমাদের মুক্তির ইচ্ছেও জাগে না। বন্ধন হচ্ছে, ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে জীব বা জীবাত্মা ভাবা। বন্ধন হচ্ছে দেহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া, কর্ম্মবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। তাহলে কি স্থুল দেহত্যাগ বা মৃত্যুই আমাদের মুক্তির পথ ? না মুক্তি হচ্ছ অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি। আত্মজ্ঞানলাভই মুক্তি। এই আত্মজ্ঞান লাভের জন্য ব্যাকুলতা জেগেছে, রাজা জনকের মধ্যে।
SASANKA SEKHAR PEACE FOUNDATION - ETERNAL PEACE SEEKER.
Информация по комментариям в разработке