বিশ্বের অনেক দেশের মতো ত্বকের সুরক্ষা এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নানা রকমের প্রসাধনী ব্যবহার করা হয়ে থাকে বাংলাদেশেও।
এসব পণ্যে নানা ধরনের রাসায়নিক মিশ্রিত থাকার কারণে বিশ্বজুড়েই প্রসাধনী ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ এসব রাসায়নিক অনেকের ত্বকের জন্য কোন সুরক্ষা বা সৌন্দর্য বৃদ্ধি তো করতে পারেই না, বরং সেটি ক্ষতিকরও হয়ে ওঠতে পারে।
বিশেষ করে রং ফর্সাকারী ক্রিমগুলো নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে।
ক্রিম কি আসলেই ফর্সা করে?
লেজার মেডিকেল সেন্টারের পরিচালক ডা. ঝুমু জাহানারা খান বলছেন, আসলে কোন ক্রিমই শরীরের রংকে ফর্সা করতে পারে না। কারণ ত্বকের রঙের সাথে শরীরের ভেতরের অনেক উপাদান জড়িত রয়েছে।
তিনি বলছেন, ''এখন বাজারে অনেক সস্তা ক্রিম এসেছে, যেগুলোয় অনেক ভারী রাসায়নিক এবং ক্ষতিকারক পদার্থ রয়েছে। এগুলো খুব তাড়াতাড়ি হয়তো ফর্সা বা সাদা ইফেক্ট দিয়ে দেয়, কিন্তু কিছুদিন পরেই সেটা বরং ত্বকের জন্য নানা ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। যেমন ত্বকটা হয়তো খুব লাল হয়ে ওঠে, জ্বলছে বা রোদে যেতে পারছে না। বাংলাদেশের বাজারে যেগুলো পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগ ক্রিমই আসলে এরকম।''
''আমাদের উচিত, নিজেদের যে স্বাভাবিক সৌন্দর্য রয়েছে, সেটাকেই ঠিকভাবে রাখা এবং যত্ন করা। মনে রাখতে হবে, সাদা হয়ে যাওয়া সম্ভব না। তবে কিছু মেডিকেশন আছে যেগুলোয় ত্বক হয়তো উজ্জ্বল হয়।'' বলছেন মিজ খান।
কিন্তু যেভাবে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে অহরহ শরীরের ত্বক ফর্সা করার বিজ্ঞাপন বা ঘোষণা দেয়া হয়, তাহলে সেগুলো কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
ডা: ঝুমু জাহানারা খান বলছেন, ''মেডিকেল পণ্যের ওপর নানা নজরদারি আছে, আইন আছে। কিন্তু কসমেটিকস পণ্যের ক্ষেত্রে সেটা নেই। সে কারণে ওরা যা খুশি তাই, অনেক আজেবাজে জিনিসও কনজ্যুমার পণ্য হিসাবে বাজারে ছাড়া হয়। যেমন ফর্সা করার সস্তা ক্রিম তো অবশ্যই ত্বকের ক্ষতি করবে।''
তিনি বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া একজনের কথা শুনে আরেকজন পণ্য ব্যবহার করেন। কিন্তু একেকজনের ত্বক একেক রকম হওয়ায় কারো কারো জন্য সেটা চরম ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।
স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মাত্রায় মার্কারি ও হাইড্রোকুইনোন নামের দুটি ক্ষতিকর উপাদান থাকায় ৮টি রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই)। এই ক্রিমগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ধরণের চর্মরোগ সৃষ্টি হতে পারে বলে জানা গেছে।
বিএসটিআই বাজার থেকে ১৩ টি ক্রিমের নমুনা নিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করে। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে দুটি উপাদানের বেশি পরিমাণে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায় ৮টি ক্রিমে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি এসব ক্রিমের উৎপাদন, বিক্রি, বাজারজাত পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে। ক্রেতাদেরও অনুরোধ করা হয়েছে যাতে তারা এই ক্রিমগুলো আর ব্যবহার না করেন।
বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, গৌরী কসমেটিকস লিমিটেডের গৌরী ব্র্যান্ডের ক্রিমে ৭৫৫.৮৫ পিপিএম মার্কারি, এস জে এন্টারপ্রাইজের চাঁদনী ক্রিমে ৬২৯.৯৬ পিপিএম মার্কারি, কিউ সি ইন্টারন্যাশনাল এর নিউ ফেস ব্র্যান্ডের স্ক্রিন ক্রিমে ৫৯০.৩৮ পিপিএম মার্কারি, ক্রিয়েটিভ কসমেটিকস লিমিটেডের ডিউ ব্র্যান্ডের ক্রিমে ২৮৫.৮৮ পিপিএম মার্কারি, গোল্ডেন পার্ল কসমেটিকস প্রাইভেট লিমিটেডের গোল্ডেন পার্ল ক্রিমে ৬৫৪.১৩ পিপিএম মার্কারি, পুনিয়া ব্রাদার্স লিমিটেডের ফাইজা ক্রিমে ৫৯০.৪৫ পিপিএম মার্কারি, নূর গোল্ড কসমেটিকসের নূর ক্রিমে ১৯৩.৬৮ পিপিএম মার্কারি ও ১৯৮০.৬৮ পিপিএম হাইড্রোকুইনন, হোয়াইট পার্ল কসমেটিকসের হোয়াইট প্লাস ব্র্যান্ডের ক্রিমে ৯৪৮.৯৩ পিপিএম মার্কারি ও ৪৩৪.৭৩পিপিএম হাইড্রোকুইনোন এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিএসটিআই বলছে, নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড (বিডিএস ১৩৮২:২০১৯) অনুযায়ী মার্কারির গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ১ পিপিএম এবং হাইড্রোকুইনোনের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫পিপিএম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালিয়ের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. মো. আকরাম উল্লাহ সিকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'হাইড্রোকুইনোন একটি নির্দিষ্ট মাত্রা (২-৪ পিপিএম) পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়, অতিরিক্ত মাত্রায় থাকলেও তা ক্ষতির কারণ হবে। কিন্তু মার্কারি একটি ভারী ধাতু হওয়ার কারণে ক্রিমের মধ্যে এর ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই।'
উল্লেখ্য, ৮টি ক্রিমের প্রতিটিই হচ্ছে পাকিস্তানি ব্র্যান্ডের, যা আমদানি করে বাংলাদেশে বিক্রি করা হয়।
তবে বিএসটিআইয়ের একটি সূত্র বলছে, এ পণ্যগুলোর বৈধ কোন আমদানিক বাংলাদেশে নেই। লাগেজ পার্টির মাধ্যমে এবং চোরাই পথে এগুলো দেশে আসে। তাই সরাসরি আমাদনিকারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তবে বাজারে যারা বিক্রি করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ পণ্যগুলো আমদানির জন্য কোন আমদানিকারকই বিএসটিআইয়ের ছাড়পত্র নেয়নি। এজন্য কাউকে সরাসরি ধরার সুযোগ নেই। তবে বাজারে যেখানে পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
'এ ধরণের পণ্য যারা দীর্ঘদিন ব্যবহার করে তাদের স্ক্রিনে নানা ধরণের রোগ হতে পারে।'
বিএসটিআই বলছে, নির্দেশনা অমান্য করে কেউ যদি এগুলো আমদানি, সরবরাহ এবং বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশে চালু থাকা আটটি রং ফর্সাকারী ক্রিমের মধ্যে ক্ষতিকর মাত্রায় পারদ (মার্কারি) এবং পারদ ও হাইড্রোকুইনোন পাওয়া যায় সেগুলো নিষিদ্ধ করেছে মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই)।
সংস্থাটি জানিয়েছে, বাজারের বিভিন্ন ব্রান্ডের রং ফর্সাকারী ১৩টি ক্রিম বিএসটিআই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়।
বিএসটিআইয়ের নিয়মিত সার্ভিল্যান্স টিমের মাধ্যম এসব ব্রান্ডের পণ্য ক্রয় করে পরীক্ষা করা হয়।
সেখানে ছয়টি পণ্যের মধ্যে বিপজ্জনক মাত্রায় মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির পারদ (মার্কারি) আর দুইটি পণ্যের মধ্যে পারদ (মার্কারি) ও হাইড্রোকুইনোন পাওয়া গেছে।
Информация по комментариям в разработке