abu ayub ansari shrine (পর্ব -০২)
আবু আইয়ুব আল আনসারী (রাঃ) এর কবর, ইস্তাম্বুল, তুর্কী
হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর পূর্ণ নাম হচ্ছে খালিদ ইবনে যায়েদ ইবনে কুলায়েব আল-খাযরাজী আন্-নাজ্জারী। আবূ আইয়ূব আনসারী নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। মদীনার বনূ নাজ্জার বা নাজ্জার বংশের খাযরাজ গোত্রে তিনি ৫৯১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। এই নাজ্জার বংশের এক কন্যাকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লামের পরদাদা বা প্রপিতামহ হাশিম শাদি করেছিলেন।
হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে পরিচালিত সকল সশস্ত্র যুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিদায় হজ্জে অংশগ্রহণ করেছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে পরিচালিত সকল অভিযানেও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। হযরত উমর ইব্ন খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর খিলাফতকালে মিসরে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়। হযরত আমর ইব্নুল আস রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর সেনাপতিত্বে মিসর জয়ে হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর বিশেষ অবদান ছিল।
নবিজি (সা.) তাঁর সারা জীবনে একাধিকবার বলেছেন, আমার উম্মতের এক সেনাদল কনস্ট্যান্টিনােপল জয় করবে। কতই না মুবারক সেই সেনাদল, আর কতই না মুবারক তাদের সেনাপতি! এই ধারণা পরবর্তীকালে সাহাবিদের মনে গেঁথে যায়।
৬৭২ সাল। আমির মুয়াবিয়া (রা.) তখন খলিফা। খালিদ ইবন ওয়ালিদের (রা.) তলােয়ারের আঘাতে রােমানরা সিরিয়া-ফিলিস্তিন আর পূর্ব আনাতােলিয়া থেকে পালিয়েছে ত্রিশ বছর আগেই, যদিও তখন তাদের দখলে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সভ্য ইউরােপ। মুয়াবিয়া (রা.) সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি কনস্ট্যান্টিনােপলে অভিযান চালাবেন। আলি (রা.) এবং মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে যুদ্ধের পর থেকে নিজেদের রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নেওয়া সাহাবিদের বেশিরভাগই তখন মদিনায়। সরকারি কোনাে কাজের ধারে কাছে তারা যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।
নবিজির পতাকাবাহক আবু আইয়ুব আল আনসারি (রা.)-এর বয়স তখন আশিরও বেশি। দুর্বল শরীর। চোখে ভালাে দেখেন না। মদিনার রাস্তায় তিনি শুনতে পেলেন, কনস্ট্যান্টিনােপল অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে। আবু আইয়ুবের (রা.) মস্তিষ্কে ধ্বনিত হলাে কুরআনের আয়াত- "তােমরা আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়াে, হালকা কিংবা ভারী, যেকোনাে অবস্থায়... (সূরা আত তাওবা ৪১)
আবু আইয়ুব দেখলেন, কনস্ট্যান্টিনােপল অভিযানের খবরে মদিনাতে হইচই পড়ে গেছে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবন উমার, আব্দুল্লাহ ইবন জুবায়ের, আবু শাইবা আল আনসারি, হামিদুল্লাহ আল আনসারি, কাব ইবন মালিক, হাফিজ (রা.)-সহ তখনকার সব জীবিত সাহাবিরা তােড়জোড় শুরু করেছেন কনস্ট্যান্টিনােপলে যাওয়ার জন্য। তারা সবাই শুনেছেন, যে সেনাদল প্রথম কনস্ট্যান্টিনােপল জয় করবে, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে।বৃদ্ধ আবু আইয়ুব (রা.)-কে সবাই মিলে চেপে ধরলেন। এই অবস্থাতে অভিযানে তাকে নেওয়া কোনােমতেই ঠিক হবে না। তিনি কারও কথাই শুনলেন না। ৬৭৩ সালে মুসলিম ফ্লিট রওনা হলাে কনস্ট্যান্টিনােপল অভিযানে।
তিন দিক থেকে কনস্ট্যান্টিনােপল ঘিরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল মুসলিম বাহিনী। রােডস দ্বীপ জয় করে আব্দুল্লাহ ইবন কায়েসের নৌবাহিনী মার্মারা সাগরে গাল্লিপলি উপদ্বীপের দিক থেকে ঢুকলেন কনস্ট্যান্টিনাপলের পশ্চিমে। পূর্বে আরও এক নৌবাহিনী মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে অবরােধ করল বসফরাস, স্মার্নাতে থাকা রােমানদের নৌবহর তাদের সামনে টিকতে না পেরে পালাল। ওদিকে স্থলপথে ইয়াজিদ আর ফুজাইল ইবন উবায়েদের বাহিনী এগোতে লাগল আনাতােলিয়ার বুক চিরে। রােমানরা এগােল তাদের ঠেকাতে। আনাতােলিয়ার তীব্র শীতে মুসলিম বাহিনী টিকতে পারল না রোমানদের সামনে। ত্রিশ হাজার শহিদের লাশ রেখে তাদের পিছু হটতে হলাো আনাতােলিয়ার দিকে। আসার পথে সাইলেনিকাতে তারা পড়লেন ঝড়ের মুখে। প্রচণ্ড ঝড়ে প্রায় পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে গেল মুসলিম স্থলবাহিনী। জলে তখন অন্য বিপদ। কনস্ট্যান্টিনােপলের দেয়াল পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু রােমানদের বিখ্যাত গ্রিক ফায়ারের সামনে একের পর এক মুসলিম জাহাজ পুড়ে যেতে থাকল। তার মধ্যেই কনস্ট্যান্টিনােপলের বিখ্যাত থিওডােসিয়ান ওয়ালে হানা দিলেন অভিজ্ঞ মুসলিম বীরদের নিয়ে গড়া বাহিনী। কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ হলাে না। থিওডােসিয়ান ওয়ালের সামনে রােমানদের তিরে শহিদ হলেন আবু শাইবা আল আনসারি, হাফিজ আনসারি, হামিদুল্লাহ আল আনসারি, কাব ইবন মালিক (রা.)।
পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে যখন অবরোেধ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে মুসলিম বাহিনী, আবু আইয়ুব (রা.) তখন মুসলিম বাহিনীর কমান্ডারকে ডাকলেন। তার হাতে হাত রেখে বললেন, 'যদি কনস্ট্যান্টনোপল জয় না-ও হয়, আর আমি মারা যাই, তাহলে কনস্ট্যান্টিনােপলের সবচেয়ে কাছে যতদূর তােমরা যেতে পার, সেখানে আমাকে কবর দিও।'
এর দুদিন পর মারা গেলেন আবু আইয়ুব আল আনসারি (রা.)। ফিরে আসার আগে তাকে কবর দিয়ে আসা হলাে থিওডােসিয়ান ওয়ালের ভেতরের দিকের একটা জায়গাতে। যেটা নাকি ছিলো কন্সট্যান্টিনোপলের সবচেয়ে কাছাকাছি জায়গা। ধীরে ধীরে তার কবরটা পরিণত হলো এক তীর্থস্থানে। আল তাবারি, আল বালাজুরি, জাকারিয়া আল কাজওয়াইনি, রােমান সম্রাট ম্যানুয়েল ওয়ান এবং পিকে হিট্টি, সবাই লিখে গেছেন, যখনই কনস্ট্যান্টিনােপলে খরা দেখা দিত, খ্রিষ্টান পাদ্রিরা তখন আবু আইয়ুব আল আনসারির (রা.) কবর খুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন।যতবার এভাবে প্রার্থনা করা হয়েছে, প্রতিবারই খরা দূর হয়েছে, আকাশ থেকে নেমে এসেছে অঝাের ধারায় বৃষ্টি।
কালক্রমে এই মাযার শরীফ সব ধর্মের মানুষের তীর্থস্থানে পরিণত হয়। তাঁর মাযার শরীফ থেকে আকাশ সমান আলোকিত করে একটা জ্যোতি উত্থিত হয় বলে জানা যায়। উসমানী সুলতানগণ তাঁদের অভিষেক অনুষ্ঠান এই মাযার শরীফে এসে সম্পন্ন করতেন।
আবু আইয়ুব আল আনসারী (রাঃ) এর কবরের আশেপাশে রয়েছে অসংখ্য কবর। তার পরবর্তী সময়ে যতো বিখ্যাত এবং বুজুর্গ ব্যাক্তি মারা যেতেন সবার ইচ্ছা থাকতো তাদেরকে যেনো এই বিখ্যাত সাহাবীর কবরের পাশে মাটি দেওয়া হয়।
Информация по комментариям в разработке