খুতবা কী ও কেন?
খুতবা আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো ভাষণ: বক্তৃতা, প্রস্তাবনা, ঘোষণা, সম্বোধন, উপস্থাপনা ইত্যাদি। খুতবা হলো জুমার নামাজের আগে, উভয় ঈদের নামাজের পরে, হজে আরাফার দিনে মসজিদে নামিরাতে, বিয়ের অনুষ্ঠানে ও বিভিন্ন ইসলামি অনুষ্ঠানে খলিফার প্রতিনিধি, দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা ইমাম ও খতিব কর্তৃক প্রদত্ত প্রাসঙ্গিক বক্তৃতা বা ভাষণ। যিনি খুতবা দেন তাঁকে ‘খতিব’ বলা হয়। সাধারণত যেসব মসজিদে আলাদা খতিব নেই, সেখানে পেশ-ইমাম বা প্রধান ইমাম অথবা ইমাম ও সানি ইমাম (সহকারী ইমাম) খুতবা প্রদান করেন এবং জুমার ও ঈদের নামাজে নেতৃত্ব দেন। জুমার খুতবা নামাজের আগে এবং ঈদের নামাজসহ অন্যান্য নামাজে খুতবা পরে দেওয়া হয়। ঈদ ও জুমার খুতবা ওয়াজিব, অন্যান্য খুতবা সুন্নত।
খুতবার মধ্যে যেসব বিষয় থাকা সুন্নত
হামদ (আল্লাহর প্রশংসা) দ্বারা শুরু করা, ছানাখানি (গুণগান) করা, শাহাদাতাঈন (তওহিদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য) পাঠ করা, দরুদ শরিফ পড়া, কোরআনে করিমের প্রাসঙ্গিক আয়াত তিলাওয়াত করা, সংশ্লিষ্ট হাদিস পাঠ করা, প্রয়োজনীয় মাসআলা বর্ণনা করা, ওয়াজ-নসিহত বয়ান করা, উপদেশ দেওয়া, সৎকর্মে উদ্বুদ্ধকরণ ও মন্দ কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করা, মুসলমানদের জন্য দোয়া করা।
খতিবের করণীয় সুন্নত
অজু অবস্থায় থাকা (পবিত্র থাকা)। জুমার খুতবার প্রারম্ভে (মিম্বারে) বসা। সব খুতবা দাঁড়িয়ে দেওয়া। জুমার খুতবা মিম্বারে দাঁড়িয়ে দেওয়া। মুসল্লিদের (শ্রোতা-দর্শকদের) দিকে ফিরে খুতবা দেওয়া। খুতবা আরম্ভের আগে মনে মনে ‘আউজুবিল্লাহ’ ও ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া। খুতবা আরবি ভাষায় হওয়া। সশব্দে (শ্রোতা-দর্শক শুনতে পায় এমনভাবে) খুতবা পরিবেশন করা। উভয় খুতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া। উভয় খুতবা (প্রতিটি) ‘তিওয়ালে মুফাছ্ছল’ (সুরা হুজুরাত থেকে সুরা বুরুজ পর্যন্ত) সুরার চেয়ে দীর্ঘ না হওয়া। দুই খুতবার মাঝে বসা। ঈদের খুতবায় প্রারম্ভে না বসা। ঈদের প্রথম খুতবার শুরুতে ৯ বার; ঈদের দ্বিতীয় খুতবার শুরুতে ৭ বার এবং শেষে ১৪ বার তাকবির বলা।
খুতবায় যা যা থাকা উচিত
পূর্বসূত্র (বিগত আলোচনার সারাংশ ও আজকের বিষয়ের সঙ্গে পূর্বাপর সম্পর্ক)। আজকের বিষয়: প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা। গত সপ্তাহের স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি পর্যালোচনা। আগামী সপ্তাহের করণীয় আমল আলোচনা। (চাঁদের মাসের আমল)। সমকালীন প্রসঙ্গ ও দিকনির্দেশনা। মধ্যপন্থা অবলম্বন। ঐক্যের প্রচেষ্টা ও অনৈক্য দূর করা।
মিম্বার প্রসঙ্গ
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথমত একটি খেজুরগাছের খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। মিম্বার তৈরি হওয়ার পর তিনি তার ওপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। ওই মিম্বারে তিনটি তাক ছিল। নবীজি (সা.) তৃতীয় তাকে দাঁড়াতেন ও বসতেন। নবীজি (সা.)-এর ওফাতের পর হজরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতের সময় তিনি দ্বিতীয় তাকে দাঁড়াতেন। হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতের সময় তিনি তৃতীয় তাকে দাঁড়াতেন। অতঃপর হজরত উসমান (রা.)-এর খিলাফতের সময় তিনি দ্বিতীয় তাকে দাঁড়াতেন এবং এ প্রথাই বর্তমানে প্রচলিত। তবে প্রয়োজনে মিম্বারের তাকের সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে এবং সুবিধানুযায়ী খতিব যেকোনো তাকে দাঁড়াতে পারেন।
খতিবের ‘আসা’ বা যষ্টি প্রসঙ্গ
রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা.) সাধারণত তৎকালীন সামাজিক পরিবেশের প্রয়োজনে ‘আসা’ বা যষ্টি বহন করতেন। চলাফেরার সুবিধার জন্য অনেকে এখনো তা সহায়করূপে ব্যবহার করেন। আসলে যষ্টি বা লাঠি একটি প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক বস্তু। যাঁরা এটি ব্যবহার করেন, তাঁরা দাঁড়ালে সাধারণত তা হাতেই রাখেন এবং বিভিন্নভাবে এর ওপর হেলান, ঠেস বা ভর দিয়ে থাকেন। পবিত্র কোরআনে হজরত সুলাইমান (আ.)-এর লাঠির বিবরণ বিবৃত হয়েছে এবং হজরত মুসা (আ.)-এর লাঠির কথা আলোচিত হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)ও যেহেতু লাঠি ব্যবহার করেছেন, তাই অনেকে খুতবা দেওয়ার সময় হাতে যষ্টি ধারণ সুন্নত ও উত্তম মনে করেন। আবার অনেক ফকিহর মতে, এটি জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ; তাই শুধু খুতবার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট নয়
খতিবের কতিপয় গুণাবলি
মোত্তাকি (তাকওয়া), মুখলিস (ইখলাস), আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল (তাওয়াক্কুল), বিজ্ঞ আলেম, ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু, কপটতামুক্ত, সরলমনা, বিনয়ী, সুমিষ্টভাষী, ভদ্র। এ ছাড়া খতিবের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স, অবয়ব (সুরত), আখলাক (সিরত), পোশাক-আশাক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ।
খতিবের করণীয়
বয়ানের আগে প্রস্তুতি গ্রহণ অপরিহার্য। শ্রোতার মনোযোগের প্রতি লক্ষ রাখা। সুন্দরভাবে সূচনা করা। দর্শক-শ্রোতার বিরক্তি উদ্রেক করে এমন আলোচনা পরিহার করা। দর্শক-শ্রোতার ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধি বিবেচনা করে কথা বলা। সমস্যা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী সমাধানের পথ দেখানো। বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে ক্রমানুসারে উপস্থাপন করা। কোনো বিষয়ে সরাসরি কাউকে আক্রমণ বা ইঙ্গিত করে না বলা। দোষের বিষয়গুলো নিজেকে দিয়ে উদাহরণ দেওয়া। সঠিক বক্তব্য প্রদান করা। পরিণতি চিন্তা করে কথা বলা। সব বিষয়ে মতামত না দেওয়া। তাৎক্ষণিক মন্তব্য না করা। জানার সবটুকু না বলে শুধু প্রয়োজনীয় কথাটুকু বলা। হেকমতের সঙ্গে কথা বলা। সম্বোধনের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনা। অতি দ্রুত তালে বা অতি ধীর লয়ে কথা না বলা। গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো প্রয়োজনে দুবার, তিনবার করে বলা। মনে রাখতে হবে, এতে যেন শ্রোতার ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে। আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করে বয়ানের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা আনয়ন করা। আকর্ষণীয় সহিহ কাহিনি দ্বারা শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখা। শায়ের-আশআর, কবিতা ও প্রবাদবাক্য দ্বারা শ্রীবৃদ্ধি করা। উদাহরণ দিয়ে বিষয়কে বোধগম্য করা। উদ্ধৃতি যেন নির্ভুল হয় তা লক্ষ রাখা। শব্দ, বাক্য ও উচ্চারণ যেন শুদ্ধ হয় তা খেয়াল রাখা। নিজের কথায় ও কাজে যেন মিল থাকে সেদিকে যত্নবান থাকা। ইতিবাচক কথা ও আশার বাণী শোনানো। সুন্দরভাবে শেষ করা।
আলোচনার বিন্যাস যেমন হতে পারে
আমলি কথা, ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত বিষয়াবলি, প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক মাসআলা, নবী-কাহিনি, আউলিয়া-কাহিনি, একটি ফরজ আমল, একটি হারাম কাজ, একটি কবিরা গুনাহ, একটি আরবি (সুরা ও দোয়ার) শব্দার্থ, একটি আয়াত বা ছোট সুরা মাশক, প্রশ্নোত্তর (সম্ভব হলে)।
Информация по комментариям в разработке