ইসলামপূর্ব যুগে পেশিশক্তির জোরে মানুষ অন্যায় করে বেড়াত। এমনকি মানুষকে হত্যা করতেও কোনো দ্বিধাবোধ করত না। কারণ তাদের মধ্যে গোত্রের সাথে গোত্রের সার্বক্ষণিক যুদ্ধ লেগে থাকত। মনে হতো, এটা যেন তাদের পেশা। অতঃপর মহানবী সা:-এর আগমন ঘটে। তিনি এসব অরাজকতা দেখে অস্থির হয়ে পড়তেন। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। অতঃপর ইসলামের আগমন হলে এসব হত্যা, রক্তপাত, অরাজকতা, সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
প্রাক-ইসলামি যুগে আরব সমাজে যখন ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির প্রচলন ছিল তখন পেশিশক্তির জোরে খুনখারাবি, হত্যাকাণ্ড, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, ঘুষ-দুর্নীতি—সবকিছুই অবাধে চলত। শান্তির ধর্ম ইসলামের আবির্ভাবে সব রকম হত্যা, রক্তপাত, অরাজকতা, সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে শান্তি, স্থিতিশীলতা, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার মর্মবাণী ঘোষণা দিয়ে বিদায় হজের ভাষণে বললেন, ‘তোমাদের রক্ত তথা জীবন ও সম্পদ পরস্পরের জন্য হারাম; যেমন আজকের এই দিনে, এই মাসে ও এই শহরে অন্যের জানমালের ক্ষতিসাধন করা তোমাদের ওপর হারাম।’
‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানবজাতির জীবন-মরণ, মানসম্মান—সবকিছুই আল্লাহর পবিত্র আমানত। কোনো ব্যক্তি যদি এ আমানতের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে, তবে এর জন্য তাকে আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। হত্যার বদলে হত্যার ন্যায় কঠিন শাস্তি পেতে হবে। তা সত্ত্বেও সামান্য তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে অথবা হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে বা পেট্রলবোমা মেরে বা গুলি করে অহেতুক নিরীহ মানুষজনকে হত্যা করা হচ্ছে। কেউ আবার সামান্য অর্থসম্পদের মোহে গোটা পরিবারকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয় না। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে ভেসে ওঠে এসব হত্যাকাণ্ডের বীভৎস চিত্র। অথচ হত্যা এমন একটি জঘন্য অপরাধ, যা আল্লাহর কাছে কঠিন ও মারাত্মক গুনাহ হিসেবে বিবেচিত। হাদিসের কথায়, ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ (তিরমিজি)
একজন নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যা করারই নামান্তর। আর কোনো ব্যক্তি যদি কারও প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন পৃথিবীর সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। তাই তো অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকে সবচেয়ে বড় গুনাহ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নরহত্যার ভয়ানক পরিণাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৩২)
ইসলাম অন্যায়ভাবে মানব সন্তানকে হত্যা করা কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। নিরপরাধ ব্যক্তিদের হত্যা করা ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। পরিবারের কোনো একজন সদস্য নিহত হলে গোটা পরিবারের ওপরই নেমে আসে শোকের ছায়া। আজীবন তারা এ শোক বয়ে বেড়ায়। তা ছাড়া পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক নানাবিধ সমস্যা তাদের ওপর চেপে বসে। সর্বোপরি মাতৃ ও পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় নিহতের সন্তান-সন্ততিরা। বিধবা হয় স্ত্রী অথবা স্বামী হয় স্ত্রীহারা। মা-বাবা হারান তাঁদের কলিজার টুকরা সন্তান। এর চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে? তাই তো আল্লাহ তাআলা জালিমকে অবকাশ দেন, এরপর যখন পাকড়াও করেন তখন আর তাকে ছাড় দেন না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ৪২)
কিয়ামতের দিন নরহত্যার বিচার করা হবে সর্বাগ্রে, তারপর অন্যান্য অপরাধের শাস্তি হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফায়সালা হবে, তা হলো রক্তপাত বা হত্যা সম্পর্কিত।’
মানবতা ও নৈতিকতার কোনো স্তরেই নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও অহেতুক রক্তপাতকে সমর্থন করা হয় না। মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পবিত্র কোরআনে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা করো না।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩৩) কোনো মুসলমান যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অবৈধ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না হবে, ততক্ষণ দ্বীনের পাকড়াও থেকে মুক্ত থাকবে। অবৈধ হত্যার আগ পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহর রহমতের মধ্যে বিচরণ করতে থাকে। যখনই কেউ অবৈধ হত্যায় লিপ্ত হয় তার ওপর থেকে আল্লাহর রহমত উঠে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একজন প্রকৃত মুমিন তার দ্বীনের ব্যাপারে পূর্ণ প্রশান্ত থাকে, যে পর্যন্ত সে অবৈধ হত্যায় লিপ্ত না হয়।’ (বুখারি) সব গুনাহ ক্ষমা করলেও হত্যাকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। হত্যাকৃত ব্যক্তি ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যুবক-বৃদ্ধ—যে রকমই হোক না কেন, হত্যাকারীকে এর শাস্তি পেতেই হবে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যদি আসমান-জমিনের সব অধিবাসী একজন মুসলমানকে অবৈধভাবে হত্যা করার জন্য একমত পোষণ করে, তবে আল্লাহ তাদের সবাইকে অবশ্যই জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)
মানবসমাজে কোনো রকম অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, হানাহ
#মানুষ_হত্যা #রহস্য #মাহমুদুলহাসান
Информация по комментариям в разработке