জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নারীদের সক্রিয় ও সর্বাত্মক অংশগ্রহণ আমাদের মনের ঈশান কোণে একটা আশার আলো জমে উঠেছিলো। আমরা ধরে নিয়েছিলাম এবারে বাংলাদেশের নারীরা দেশের মূলধারার রাজনীতির মাঠে গৌরবের সাথে স্থান করে নিবে। রাজনীতির মাঠে নারীরা আগের চাইতে অধিক পরিমাণে দৃশ্যমান হবেন। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরে একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আমাদের দরজায় এসে দাঁড়াতে থাকে।
প্রশ্নটা হলো, “নারীরা কোথায় গেলো?”
গণঅভ্যুত্থানের প্রাথমিক জোয়ারটা এসেছিলো ১৪ জুলাই রাতে যখন ছাত্রীদের হল থেকে রাত দশটায় হলের ছাত্রীরা হলগেটের তালা ভেঙ্গে দলে দলে মিছিল নিয়ে বেরোতে থাকে। সাধারণত মেয়েদের হলগুলোর সদর দরজায় রাত নয়টার আগেই তালা পড়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি প্রতিষ্ঠানেও নারী শিক্ষার্থীদের জন্য হলগুলোতে সান্ধ্য আইন জারি আছে এবং ২০২৫ সালে এসেও অনেকে নারীদের ওপর এই বাড়তি বিধিনিষেধের বিষয়টিকে স্বাভাবিক মনে করেন। ২০২৪ এর জুলাই মাসে অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যাত্যয় হয়েছিলো। ওই সময়ে বাংলাদেশের মানুষ আরো অদ্ভুত সুন্দর সব ছবি দেখতে পায়। একটি মেয়ে অদম্য সাহস নিয়ে পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যায়, ভাইকে ছেড়ে না দিলে সে গাড়ির সামনে থেকে সরবে না। ঠাকুরগাঁওয়ের এক দল মেয়েকে দেখেছি পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ়, সাহসী এবং ক্ষুব্ধ গলায় চিৎকার দিয়ে মিছিল করছে, তাদের স্লোগান ছিলো, “কে এসেছে কে এসেছে, পুলিশ এসেছে, পুলিশ এসেছে, কী করছে কী করছে? স্বৈরাচারের পা চাটছে।“ বিভিন্ন এলাকায় নারীরা মিছিলে খাবার পানি নিয়ে গেছেন, ছেলেমেয়েদেরকে থাকতে দিয়েছেন। আরও দেখেছি, ছেলেকে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর মা তার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন। তখনো কিন্তু হাসিনা ক্ষমতায়, রেজিমের দমন নিপীড়নের সমস্ত যন্ত্র তখনো পুরোদমে সক্রিয়। এর মাঝে এই নারীরা অপরিসীম সাহসের সাথে এগিয়ে না আসলে এই অভ্যুত্থান জনগণের অভ্যুত্থান হয়ে উঠতে পারতো না, এই বিষয়ে প্রায় সবাই একমত। কিন্তু অভ্যুত্থানের শেষেই আমরা দেখতে পেলাম অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বেশ কয়েকজন প্রথম সারির নারী নেত্রী জঘন্য সাইবার বুলিং এর শিকার হলেন, তাদের কেউ কেউ অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনীতির মাঠে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই মর্মে অভিযোগ করলেন। এছাড়াও অভ্যুত্থান পরবর্তী নানান জমায়েতে নারীদের সংখ্যা আবার আগের মতই করে আঙ্গুলে গুনতে পারার অবস্থায় নেমে এলো, তারপর সবাই প্রশ্ন করতে থাকলো, নারীরা কোথায় গেলো?
এই প্রশ্নের সাথে আরেকটা প্রশ্নও সামনে আসে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীরা আসলে কোথায় ছিলো?
বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিতে নারীর অবস্থান কখনোই উল্লেখ করার মতো কিছু ছিলো না। এই বিষয়টা ব্যখ্যা করা জটিল। যেই দেশে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের প্রধান দুই দলের শীর্ষ পদে আছেন নারী, সরকার পরিচালনায় তিন দশকেরও বেশি সময় ছিলেন তারা; এরপরেও সেই দেশের রাজনীতিতে নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। সরকারের নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু এরপরও নির্ধারিত ৩৩ শতাংশ বা তার কাছাকাছি নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি কোনো দল।
রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের অপ্রতুল অংশগ্রহণ এবং দলগুলোর গঠনতন্ত্রে যথাযথ নিয়ম মেনে অন্তর্ভুক্তির অভাব রয়েছে। এই অবস্থায়, এই রাজনৈতিক দলগুলোর নারী নেতৃত্বের কাছ থেকে আমরা বাংলাদেশের নারীদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কতটা দেখতে পাই অথবা ভবিষ্যতে দেখতে পাবো কি না, এই প্রশ্ন থাকে। এই প্রশ্নটি আসে, কারণ প্রায়ই নারীদের নানান সামাজিক আন্দোলনে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর নারী নেতৃত্বকে সাধারণ নারীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিতে দেখি না। ফলে,মনে হয় যেন রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয় নারীরা ঠিক নারীর রাজনীতি করে উঠতে পারেন না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী প্রশ্ন অত্যন্ত গ্রুরুত্বপূর্ণ। অনেকসময় নারীদের প্রশ্নে সামান্য ভুল পদক্ষেপও গোটা রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, নারীরা সঠিক নেতৃত্বের অভাবে এই গুরুত্বের জায়গাটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে নিজেদের দাবি দাওয়া আদায় করতে পারে না। ফলে, এইদেশে নারীদের রাজনীতি হয় না। হয় নারীদের নিয়ে রাজনীতি। দেশে চলমান ঘটনাপ্রবাহেও আমরা দেখতে পাচ্ছি কিভাবে নারীদের রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে নারীদের নিয়ে রাজনীতি। এই বিষয় নিয়েই আমাদের পরবর্তী আয়োজন - গণতন্ত্র-আলাপ পর্ব-১২: নারীর রাজনীতি, রাজনীতিতে নারী।
আলোচক
ড. নিলোফার চৌধুরী মনি, সাবেক সংসদ সদস্য ও সহ-সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বিএনপি
তাসলিমা আখতার, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি
তাজনূভা জাবীন, যুগ্ম আহবায়ক, কেন্দ্রীয় কমিটি, জাতীয় নাগরিক পার্টি
ড. হাবিবা আখতার চৌধুরী সুইট, রাজনীতি বিভাগীয় সম্পাদিকা, মহিলা বিভাগ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
সঞ্চালক
জান্নাতুল মাওয়া আইনান, সদস্য, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক
আলাপটি দেখার ও শুনার জন্যে সকলকে আমন্ত্রণ জানাই।
Информация по комментариям в разработке