নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে টেকসইভ বিষ্যৎ
-মোহাম্মদ শফিউল্লাহ
একবিংশ শতাব্দীর এই ক্রান্তিকালে যখন বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন এবং জ্বালানি নিরাপত্তার মতো দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তখন বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে এই খাতে এক নতুন সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে। জীবাশ্ম জ্বালানির সীমিত মজুদ এবং পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব—এই দ্বিমুখী সংকট থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। জনবহুল একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এই পরিবর্তন কেবল অপরিহার্যই নয়, এটি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করার পাশাপাশি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকেও সুদৃঢ় করবে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিংহভাগই গ্যাসভিত্তিক। তবে প্রাকৃতিক গ্যাসের সীমিত মজুদ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের অস্থিরতা দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, যা কেবল জ্বালানি নিরাপত্তাই নিশ্চিত করবে না, বরং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে পরিবেশ সুরক্ষাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি, এই খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ এবং প্রযুক্তির স্থানান্তরেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।
বর্তমান বিশ্ব নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকেছে এবং এর নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। এই খাতে চীন এক অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যার পেছনে রয়েছে সৌর ও বায়ুশক্তির ব্যাপক ব্যবহার। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রাজিল নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থা (IRENA)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে রেকর্ড পরিমাণ ৫৯৫ গিগাওয়াট নতুন সক্ষমতা যুক্ত হয়েছে, যার ফলে বৈশ্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড়ো অংশ এখন এই উৎস থেকে আসছে। তবে, নতুন সংযোজিত সক্ষমতার প্রায় ৮৩.৬শতাংশ চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা বৈশ্বিক বৈষম্যকে প্রকট করে তোলে। এই বৈশ্বিক চিত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারত এই অঞ্চলে এক বৃহৎ নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, তাদের উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ২৪ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাচ্ছে এবং ভুটান জলবিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে নিজেদের কার্বন-নেগেটিভ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাও যথাক্রমে ২১.১৮ শতাংশ ও ৩৪.৭ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাচ্ছে। তবে, বাংলাদেশ এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ভরশীল হলেও সরকার সৌর ও বায়ুশক্তির মতো উৎসগুলোকে কাজে লাগিয়ে এই খাতে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থাকে মোট ১৬২৫.৯১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এই উৎপাদনের সিংহভাগই আসে সৌরশক্তি থেকে, যার পরিমাণ ১৩৩১.৯২ মেগাওয়াট। এছাড়া জলবিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস ও বায়োমাস থেকেও যথাক্রমে ২৩০, ৬২.৯, ০.৬৯ ও ০.৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। গত ২৩ জুলাই ২০২৫ তারিখে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১৬৭৯৪ মেগাওয়াট, যেখানে নবায়নযোগ্য উৎসগুলোর অবদান ছিল তুলনামূলকভাবে কম। এই প্রেক্ষাপটে, সরকার ২০৩১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায়, ‘জাতীয় রুফটপ সোলার কর্মসূচি’র মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি ভবনগুলোতে ২০০০ থেকে ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়াও উন্মুক্ত দর পদ্ধতির মাধ্যমে মোট ৫৫টি স্থানে ৫২৩৮ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা চারটি প্যাকেজে বিভক্ত করে বাস্তবায়ন করা হবে। এই পদক্ষেপগুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ৭ অর্জনে এবং সবার জন্য সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিভিন্ন উৎসগুলোর মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশ একটি সৌর বিকিরণ সমৃদ্ধ দেশ হওয়ায় এখানে সোলার হোম সিস্টেম এক সফল উদ্যোগ হিসেবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু পরিবারকে আলোকিত করেছে। এর পাশাপাশি, কৃষিক্ষেত্রে সৌর সেচ পাম্পের ব্যবহার বাড়ছে এবং সরকার বৃহৎ আকারের সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রুফটপ সোলার প্যানেল স্থাপনে বিশেষ জোর দিচ্ছে। বায়ু শক্তির ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল এবং কিছু সমতল ভূমিতে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে অফশোর বায়ু শক্তি (Offshore Wind Energy) থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ অনেক। সরকার এই খাতে গবেষণা ও পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ সীমিত হলেও পাহাড়ি অঞ্চল ও চা বাগানে ছোটো আকারের প্রকল্প স্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর পাশাপাশি, প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টিও সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে নেপাল থেকে স্বল্প পরিমাণে জল বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, তাই এখানে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কৃষি ও পশুর বর্জ্যকে বায়োমাস শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। শহরাঞ্চলের ক্রমবর্ধমান বর্জ্যকে ব্যবহার করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ (Waste-to-Energy) উৎপাদনের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে সরকার নানামুখী নীতি ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ২০২৫ এই খাতের উন্নয়নে একটি সুস্পষ্ট কাঠামো তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি, নেট মিটারিং নীতি গ্রাহকদের নিজেদের উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বিক্রি করার সুযোগ দেয়, যা ব্যক্তি পর্যায়ে
: https://newturn24.com/নবায়নযোগ্য-জ্বা...
Информация по комментариям в разработке