ভব নদীর তুফান দেখে ভয়ে প্রান কেঁপে ওঠে দয়াল আমার #friendsmusicbd
বাউল গান বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত সংগীতের একটি অনন্য ধারা। এটি বাউল সম্প্রদায়ের নিজস্ব সাধনগীত। আবহমান বাংলার প্রকৃতি, মাটি আর মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা একাত্ম হয়ে ফুটে ওঠে বাউল গানে। আরো ফুটে ওঠে সাম্য ও মানবতার বাণী। এ ধারাটি পুষ্ট হয়েছে পঞ্চদশ শতাব্দীর তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের ভাব, রাধাকৃষ্ণবাদ, বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্ব ও সুফি দর্শনের প্রভাবে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব সতের শতকে। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধব বিবি। গবেষকদের মতে, নিজ দেহের মধ্যে ঈশ্বরকে পাওয়ার তীব্র ব্যাকুলতা থেকে বাউল ধারার সৃষ্টি। বাউল সাধকদের সাধনার মাধ্যম হচ্ছে গান। সাধকের কাছে সাধন-ভজনের গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশ পায় গানের মাধ্যমেই। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে যে পরম সুন্দর ঈশ্বরের উপস্থিতি, সেই অদেখাকে দেখা আর অধরাকে ধরাই বাউল সাধন-ভজনের উদ্দেশ্য। বাউলের ভূখণ্ড তার দেহ, পথপ্রদর্শক তার গুরু, জীবনসঙ্গী নারী, সাধনপথ বলতে সুর, আর মন্ত্র বলতে একতারা। ভিক্ষা করেই তার জীবনযাপন। ভিক্ষা না পেলেও তার দুঃখ নেই। তার যত দুঃখ মনের মানুষকে না পাওয়ার। বাউলের সাধনপথ যত দীর্ঘায়িত হয়, ব্যাকুলতা তত বাড়ে; দুঃখ যত গভীর হয়, গান হয় তত মানবিক। বাউলরা তাদের দর্শন ও মতামত বাউল গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে থাকে। বাউল মতে সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালন সাঁইয়ের গানের মাধ্যমে উনবিংশ শতাব্দী থেকে বাউল গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন শুরু করে। তিনিই শ্রেষ্ঠ বাউল গান রচয়িতা হিসেবে বিবেচিত হন। ধারণা করা হয় তিনি প্রায় দু'হাজারের মত গান বেধেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বাউল গান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন যা তার রচনাতে লক্ষ করা যায়। সাধারণত বাউলেরা যে সংগীত পরিবেশন করে তাকে বাউল গান বলে। বাউল গান বাউল সম্প্রদায়ের সাধনসঙ্গীত। এটি লোকসঙ্গীতের অন্তর্গত। এ গানের উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। অনুমান করা হয় যে, খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক কিংবা তার আগে থেকেই বাংলায় এ গানের প্রচলন ছিল। বাউল গানের প্রবক্তাদের মধ্যে লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্, সিরাজ শাহ্ এবং দুদ্দু শাহ্ প্রধান। এঁদের ও অন্যান্য বাউল সাধকের রচিত গান গ্রামাঞ্চলে ‘ভাবগান’ বা ‘ভাবসঙ্গীত’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ এসব গানকে ‘শব্দগান’ ও ‘ধুয়া’ গান নামেও অভিহিত করেন। বাউল গান সাধারণত দুপ্রকার দৈন্য ও প্রবর্ত। এ থেকে সৃষ্টি হয়েছে রাগ দৈন্য ও রাগ প্রবর্ত। এই ‘রাগ’ অবশ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ নয়, ভজন-সাধনের রাগ।
বাউল গানঃ গাছের পাতা টাকা কেন হয় না, তরুন খ্যাপা ও আনন্দ খ্যাপা, শান্তিনিকেতন।
বৈশিষ্ট্য
বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের মতো বাউল গানে ‘রাগ’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ‘রাগ’ অর্থে অভিমান এবং প্রেমের নিবিড়তা বোঝায়। কাঙ্ক্ষিতজনের প্রতি নিবেদিত প্রেমের প্রগাঢ় অবস্থার নামই রাগ। রাগ দৈন্যে এমন ভাবই লক্ষণীয়। বাউলরা তাদের সাধনপন্থাকে রাগের কারণ বলে অভিহিত করে (আমার হয় না রে সে মনের মত মন/আগে জানব কি সে রাগের কারণ)। বাউল গান সাধারণত দুটি ধারায় পরিবেশিত হয় আখড়া আশ্রিত সাধনসঙ্গীত এবং আখড়াবহির্ভূত অনুষ্ঠানভিত্তিক। আখড়া আশ্রিত গানের ঢং ও সুর শান্ত এবং মৃদু তালের। অনেকটা হাম্দ, গজল কিংবা নাত সদৃশ্য। লালন শাহ্-এর আখড়ায় বসে ফকিররা এ শ্রেণির গান করে থাকে। অপর ধারার চর্চা হয় আখড়ার বাইরে অনুষ্ঠানাদিতে, জনসমক্ষে। এ গান চড়া সুরে গীত হয়। সঙ্গে একতারা, ডুগডুগি, খমক, ঢোলক, সারিন্দা, দোতারা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। তাল দাদরা, কাহারবা, কখনও ঝুমুর, একতালা কিংবা ঝাঁপতাল। শিল্পীরা নেচে নেচে গান করে। কখনও গ্রাম এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে বাউল গানের মাধ্যমে তা নিরাময়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়। বাউলরা কখনও একক আবার কখনও দলবদ্ধভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করে। এ গানের একজন মুল প্রবক্তা থাকে। তার সঙ্গে অন্যরা ধুয়া বা ‘পাছ দোয়ার’ ধরে। বাউল গানে কেউ কেউ শাস্ত্রীয় রাগসঙ্গীতের প্রভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু এ গান মূলত ধর্মীয় লোকসঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উন্মেষ ও বিকাশ লোকসঙ্গীতের অনেক পরে। আধুনিক শিল্পীদের কণ্ঠে কখনও কখনও রাগের ব্যবহার হলেও তা সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়। বাউল গানে সাধারণত দুধরনের সুর লক্ষ করা যায় প্রথম কলি অর্থাৎ অস্থায়ীতে এক সুর এবং অন্য সব কলিতে কিছুটা ভিন্ন সুর। সবশেষে দ্রুতগতিতে দ্বিতীয় কলির অংশবিশেষ পুনরায় গীত হয়। এ গানে অস্থায়ী এবং অন্তরাই প্রধান। অস্থায়ীকে কখনও ধুয়া, মুখ বা মহড়া বলা হয়। দ্রুত লয়ের এ গানে প্রতি অন্তরার পর অস্থায়ী গাইতে হয়। কোনো কোনো গানে সঞ্চারী থাকে; আবার কোনো কোনো গানে নাচেরও প্রচলন রয়েছে, যার উৎস গ্রামীণ পাঁচালি গান বলে মনে করা হয়। তবে আখড়া আশ্রিত বাউল গানে নাচের প্রচলন নেই। কিছু কিছু বাউল গান কীর্তন আশ্রিত। বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে এমনটি হয়েছে। তবে বাউল গানে সুফিভাবনাই প্রবল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাউল গানে সুরের পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সহজিয়া বৈষ্ণব সুরের আধিক্য, আর বাংলাদেশে সুফি গজলের প্রভাব, যার একটি দেশজরূপ ভাবগান ও শব্দগান। বাউল গানের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এতে একটা উদাসী ভাব লক্ষ করা যায়; এর সুরে যেন মিশে থাকে না-পাওয়ার এক বেদনা। বাউল গানের একটি বড় সম্পদ তার গায়কী বা গায়নশৈলী। উল্লেখ্য যে, বাউল গান একটি বিশেষ অঞ্চলে রচিত হলেও সঙ্গীতশিল্পীদের কারণে এর ওপর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভাব পড়ে। ফলে সুর ও গায়কিতে আসে পরিবর্তন। কখনও কখনও শব্দেও পরিবর্তন ঘটে। লক্ষ করা গেছে, কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউল গান যখন সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফরিদপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ বা দিনাজপুরে গীত হয়, তখন বাণীর উচ্চারণে, সুরের প্রক্ষেপণে এবং গায়কিতে পরিবর্তন আসে। কিন্তু তারমধ্যেও মূল সুর ও বাণীর মধ্যে কমবেশি ঐক্য বজায় থাকে।
Информация по комментариям в разработке