ছাদে বাগান করার সময় প্রথমেই ছাদের আয়তন অনুসারে কাগজে কলমে খসড়া ম্যাপ করে বিভিন্ন স্থাপনা ও ভবনের কলামগুলো চিহ্নিত করে নিতে হবে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ চাহিদা ও রুচি অনুসারে সাজানো না হলে এর পুনর্বিন্যাস অত্যন্ত শ্রম সাধ্য একটি কাজ। বড় বা ভারি গাছ গুলো ছাদের বিম বা কলামের নিকটবর্তী স্থান বরাবর স্থাপন করতে হবে। ছাদ যেন ড্যাম্প বা স্যাঁতসেঁতে হতে না পারে সে জন্য রিং বা ইটের ওপর ড্রাম অথবা টবগুলো স্থাপন করলে নিচ দিয়ে আলো বাতাস চলাচল করবে এবং ছাদও ড্যাম্প হতে রক্ষা পাবে। নেট ফিনিশিংয়ের মাধ্যমেও ছাদকে ড্যাম্প প্রতিরোধ করা যায়।
চাহিদা অনুসারে হাফ ড্রাম, সিমেন্ট বা মাটির টব, স্টিল বা প্লাস্টিক ট্রে সংগ্রহ করতে হবে। অনেক সময় বসতবাড়ির ভাঙা চোরা বালতি, অব্যবহৃত তেলের বোতলও ছোটখাটো গাছ রোপণের জন্য ব্যবহার করা হয়। ঠিকমতো উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে এসব অব্যবহৃত জিনিস বাগানে ব্যবহার করা গেলে এও হতে পারে এক নতুন নান্দনিকতা। ছাদের সুবিধা মতো স্থানে স্থায়ী বেড (ছাদ ও বেডে মাঝে ফাঁকা রাখতে হবে) স্থাপন করা যেতে পারে। এসব বেডে মূলত সবজি, শাক চাষ করা যায়। চাইলে লাগানো যায় ফুলগাছ। স্থায়ী বেড বানাতে না চাইলে পুরনো চৌবাচ্চা বা জাহাজের লাইফ বোট রাখার বয়ার খোলও অনেক জায়গায় বেড হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
যেহেতু ছাদ বাগান স্বল্প পরিসরে গড়ে তোলা হয় কাজেই এর যতœ আত্তির দিকে সব সময় নজর রাখা আবশ্যক। সে জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি প্রথমেই সংগ্রহ করে নিতে হবে। এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে আছেন সিকেচার, কোদাল, কাচি, ঝরনা, বালতি, করাত, খুরপি, স্প্রে মেশিন এসব। চারা রোপণের আগে চারার উচ্চতা, শিকড়ের প্রকৃতি, সহিষ্ণুতা এসব জিনিসের প্রতি নজর রাখতে হবে। সব চারা ও গাছ ছাদ বাগানের জন্য উপযুক্ত না। যেমন
আম-বারিআম-৩ (আম্রপালি), বাউআম-২ (সিন্দুরী);
পেয়ারা-বারি পেয়ারা-২, ইপসা পেয়ারা-১;
কুল-বাউকুল-১, ইপসা কুল-১ (আপেল কুল), থাই কুল-২ ;
লেবু-বারি লেবু -২ ও ৩, বাউ কাগজি লেবু-১;
আমড়া-বারি আমড়া-১, বাউ আমড়া-১;
করমচা-থাই করমচা;
ডালিম (দেশী উন্নত);
কমলা ও মাল্টা-বারি কমলা-১, বারি মাল্টা ১;
জামরুল-বাউ জামরুল-১ (নাশপাতি জামরুল), বাউ জামরুল-২ (আপেল জামরুল) এসব।
সবজি-লালশাক, পালংশাক, মূলাশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক, লেটুস, বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ, শিম এসব।
সাধারণত ফল গাছের জন্য হাফ ড্রাম ব্যবহার করা উচিত। এর তলদেশে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য ১ ইঞ্চি ব্যাসের ৫-৬টি ছিদ্র রাখতে হবে। ছিদ্রগুলোর ওপর মাটির টবের ভাঙা টুকরো বসিয়ে দিতে হবে। ড্রামের তলদেশে ১ ইঞ্চি পরিমাণ ইটের খোয়া বিছিয়ে তার ওপর বালি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। সমপরিমাণ দো-আঁশ মাটি ও পচা গোবরের মিশ্রণ দিয়ে ড্রামটির দুই তৃতীয়াংশ ভরার পর হাফ ড্রাম অনুযায়ী ড্রাম প্রতি মিশ্র সার আনুমানিক ৫০-১০০ গ্রাম প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে এবং সম্পূর্ণ ড্রামটি মাটি দিযে ভর্তি করে নিতে হবে। ১৫ দিন পর ড্রামের ঠিক মাঝে মাটির বল পরিমাণ গর্ত করে কাক্সিক্ষত গাছটি রোপণ করতে হবে। এ সময় চারা গাছটির অতিরিক্ত শিকড়-মরা শিকড়গুলো কেটে ফেলতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে মাটির বলটি যেন ভেঙে না যায়। রোপিত গাছটিতে খুঁটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। রোপণের পর গাছের গোড়া ভালোভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। সময়ে সময়ে প্রয়োজনমতো গাছে পানি সেচ ও উপরি সার প্রয়োগ বালাই দমন ব্যবস্থা নিতে হবে। চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের সহায়তায় টব বা ড্রাম এ মাটি দেয়ার আগেই মাটি শোধন করে নেয়া যেতে পারে। গাছের বাড়-বাড়তি অনুযায়ী ২ বারে টব প্রতি ৫০-১০০ গ্রাম মিশ্র সার প্রয়োগ করে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
রোগ বালাই দমনে যথাসম্ভব রাসায়নিক কীটনাশক পরিহার করা উত্তম। স্বল্প পরিসরের বাগান বিধায় জৈবিক পদ্ধতিতেই শতভাগ রোগ বালাই দমন করা যেতে পারে। একান্তই সম্ভব না হলে পরামর্শ মোতাবেক অনুমোদিত মাত্রায় বালাইনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। কিছু দিন পরপরই গাছের রোগাক্রান্ত ও মরা ডালগুলো ছাঁটাই করতে হবে এবং কর্তিত স্থানে বোর্দপেস্ট লাগাতে হবে। গাছের ধরন অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ পরিচর্যা করতে হবে যেমন কুল খাওয়ার পর ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি গাছের সব ডাল কেঁটে দিতে হবে।
কিছু কিছু জায়গায় ছাদে বাগানের বড় সমস্যা হলো পাখির উপদ্রব বিশেষ করে ফল গাছে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য উঁচু করে তারের জালি কিংবা জাল দিয়ে পুরো ছাদের ওপর ও পাশটা ঢেকে দেয়া যেতে পারে। প্রতি বছর না হলেও ১ বছর পরপর টবের পুরনো মাটি পরিবর্তন করে নতুন গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে পুনরায় টবটি-ড্রামটি ভরে দিতে হবে। এ সময় খেয়াল বাখতে হবে গাছ যেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অপটু হাতে মাটি পরিবর্তন না করিয়ে এ ব্যাপারে দক্ষ মালি বা নার্সারির সহায়তা গ্রহণ করতে হবে।
ছাদে বাগানে নানা উপকরণ সহায়তা করার জন্য বিশেষায়িত নার্সারি ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে পুরো বাগানটাই যেন নার্সারি কৃর্তক স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ছেড়ে দেয়া না হয়। কারণ ছাদ বাগান পরিবারের সদস্যদের দৈনন্দিন হালকা কায়িক শ্রম ও বিনোদনের উৎস হিসেবেই গড়ে তোলা উত্তম। এতে পরিবারের নতুন সদস্যরা প্রবীণদের কাছ থেকে যেমন ফুল, ফল ও গাছপালা সম্পর্কে জানবে তেমনি নিজের হাতে যতœ নেয়ায় পরিবেশের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসারও জন্ম নেবে। ইট কাঠের শহরে বাস করা প্রজন্মের জন্য এটি অত্যন্ত গূরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন টেলিভিশন মিডিয়ায় প্রচারিত ছাদ বাগান বা অন্যের বাগান স্বচক্ষে দেখার পর অনেকেই ছাদ বাগানে উদ্বুদ্ধ হন। কিন্তু মেলা থেকে আর্কষণীয় ফলন্ত গাছ কিনে এনে করা বাগান বা চুক্তিভিত্তিক নার্সারি দিয়ে স্থাপন করা অনেক বাগানই টেকসই হয় না কেবল বাগানের প্রতি ব্যক্তিগত দরদ তৈরি না হওয়ার দরুন। আর ইউটিউব দেখে বা হঠাৎ টিভি বা বই পুস্তক পড়ে কোন আকর্ষণীয় জিনিস দেখে বাগান করাও যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ ব্যতিক্রমী জিনিস উদাহরণ হতে পারে না। যারা ছাদে বাগান করতে চান তারা শুরুটা সব প্রাথমিক নিয়ম মেনে করাই উত্তম। এতে বাগান টেকসই হয়।
Информация по комментариям в разработке