বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বিস্তার এখন নীরব সামাজিক মহামারিতে পরিণত হয়েছে। ক্যাসিনোকাণ্ডের পর রাজধানীর জুয়ার আসর বন্ধ হলেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শহর–গ্রাম সবখানেই জুয়া ছড়িয়ে পড়েছে। স্মার্টফোন, সুলভ ইন্টারনেট এবং সহজ অনলাইন লেনদেন ব্যবস্থার কারণে স্পোর্টস, ই-স্পোর্টস, ভিডিও গেম, ক্রিপ্টো কিংবা মিম কয়েন—সবকিছুতেই এখন এক ট্যাপে বাজি ধরা যায়।
এই সুবিধা বিশেষভাবে বিপদে ফেলেছে কম আয়ের মানুষ, ছাত্র, বেকার যুবক ও গ্রামীণ তরুণদের। বিকাশ–নগদের সহজ লেনদেনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অবৈধ বুকি–এজেন্টরা “বোনাস” ও “দ্রুত টাকা”র প্রলোভন দেখিয়ে হাজারো তরুণকে অনলাইন জুয়ার অন্ধকার চক্রে টেনে নিচ্ছে। ফলে পরিবারের সঞ্চয়, মানসিক স্থিরতা ও ভবিষ্যৎ—সবকিছু দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে।
অনলাইন জুয়ার ভয়াবহ উদাহরণ কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের গজারিয়া গ্রাম, যা এখন ‘জুয়ার গ্রাম’ নামে পরিচিত। মাত্র কয়েকজন এজেন্ট রাতারাতি কোটি টাকার মালিক হলেও শত শত মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। অনেকে অটোরিকশা বা ব্যবসার পুঁজি বিক্রি করেছে, ঋণে ডুবে পরিবার ভেঙেছে, কেউ পলাতক, কেউ আত্মহত্যার চিন্তায়—তবু প্রশাসনের কঠোর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। গজারিয়া এখন বাংলাদেশের ডিজিটাল জুয়ার সামাজিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি।
জুয়ার নেশা শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়—সহিংসতাও বাড়াচ্ছে। রাজধানীতে একাধিক ঘটনা ঘটেছে যেখানে মহাখালীতে জুয়ার নেশায় এক স্বামী নিজের স্ত্রী–সন্তানকে হত্যা করেছে, দক্ষিণখানে ঋণ ও অনলাইন জুয়ার চাপে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে খুন করেছে। দেশজুড়ে বহু তরুণ হতাশায় ভুগে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে, কারও কারও মৃত্যুও ঘটেছে। । মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ত্বরিত টাকা পাওয়ার লোভ, বেকারত্ব ও মোবাইলের সহজ অ্যাক্সেস তরুণদের ভয়ংকর আসক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা সমাজে অপরাধ ও অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।
অনলাইন জুয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সুসংগঠিত অর্থপাচার চক্র। স্থানীয় এজেন্টরা বিকাশ–নগদে টাকা তুলে হুন্ডি বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে—শুধু ২০২৩ বিশ্বকাপে জুয়ার মাধ্যমে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অন্তত ২,০০০ কোটি টাকা দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে; বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে এ চক্রের সঙ্গে যুক্ত।
এই চক্রের কাঠামো স্পষ্ট—স্থানীয় এজেন্ট টাকা সংগ্রহ করে, সেটি হুন্ডি/ক্রিপ্টোতে ভারত, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার অফশোর সার্ভারে পাঠায়। বিটিআরসি ৪,৩০০-এর বেশি সাইট ব্লক করলেও VPN ব্যবহার করে নতুন সাইট আবার চালু হয়। পুরনো ১৮৬৭ সালের আইন দিয়ে এ আধুনিক ডিজিটাল জুয়া বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
কনটেন্ট ক্রিয়েটর, টিকটক ও ফেসবুক স্টাররা বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করছেন। এমনকি ক্রিকেটার শাকিব আল হাসান, অভিনেত্রী বুবলি, নুসরাত ফারিহা ও পরি মনির মতো তারকারাও টাকার বিনিময়ে এই সাইটগুলো প্রমোশন করছেন।
ডিজিটাল জুয়ার এই বিস্তার তরুণদের শিক্ষা, ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে; গ্রাম ও শহরে লুকিয়ে লুকিয়ে জুয়ার প্রসার আগামী প্রজন্মের জন্য বড় সামাজিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন—অনলাইন জুয়া বন্ধে বিশেষ আইন, অবৈধ লেনদেন–হুন্ডি–ক্রিপ্টো নিয়ন্ত্রণে কঠোর অভিযান, স্কুল–কলেজে সচেতনতা কর্মসূচি, বুকি–এজেন্টদের নজরদারি, এবং সোশ্যাল মিডিয়া–ইউটিউবে সব ধরনের জুয়ার বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা। পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের সম্মিলিত প্রতিরোধ সবচেয়ে জরুরি।
জুয়ার এই ডিজিটাল মহামারি এখন শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়—বাংলাদেশের সামগ্রিক সমাজ, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে সম্ভাবনাময় একটি প্রজন্ম হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে আর বাংলাদেশের সামনে দাঁড়াবে ভয়াবহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
Информация по комментариям в разработке