ছান্দোগ্য উপনিষদ - সৎ ও অসৎ- ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা ?
আপনি কি রাজার চোখের অসুখ গল্পটা জানেন ? শুনুন, এক রাজার চোখের অসুখ হয়েছে। তো কবিরাজ মহাশয় বলেছেন, রাজামশাই আপনি রোজ তিন ঘন্টা সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। তো তিনি তো মহারাজা, তিনি কেন সবুজের দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করতে যাবেন। তো ঠিক হলো, রাজ্যের সবকিছু সবুজ রঙ করে দাও। তাহলে আর রাজামশাইয়ের সময় নষ্ট করে, সবুজের দিকে তাঁকিয়ে থাকতে হবে না। রাজা মশায়ের মন্ত্রী ছিল বিজ্ঞব্যক্তি। তিনি রাজামশায়কে পরামর্শ দিলেন, আপনি চোখে একটা সবুজ চশমা লাগিয়ে নিন। তাহলে আপনি সব সবুজ দেখতে পাবেন। আপনার কাছে তখন জগৎটা সবুজ হয়ে যাবে।
তো আমরা যখন জগতের দিকে তাকাই, আমরা জগৎটাকে রঙ্গিন দেখি। আসলে এই রঙ তো আসল নয়, এগুলো সব সূর্য্যের কাছ থেকে জগৎ ধার করেছে। জগৎটাকে আমরা সাদামাঠা দেখতে চাই না। তাই আমরা জগৎটার আসল রূপ দেখতে চাই না। আমি যা চাই তাই দেখি। সত্য হারিয়ে যায়। আমরা অসত্যকে দেখি, সত্যকে আমরা দেখতে পাই না।
উপনিষদ বলছে, যা-কিছুকে মানুষ সত্য বলে মনে করে, বা গ্রহণ করে, সেটাই তার সমগ্র সত্ত্বাকে, তার সমস্ত চিন্তাধারাকে, তার সমস্ত অনুভূতিকে, তার আকাঙ্খাকে আকর্ষণ করে। আমি যদি এই মিথ্যা জগৎকে সত্য বলে মনে করি, তবে তাই আমাদের সমগ্র সত্ত্বাকে আকর্ষণ করবে।
যখন আমরা যাকে সত্য বলে মনে করি, তখন আমরা তাতেই আকৃষ্ট হই । ছোটবেলায়, আমরা খেলনায় আকৃষ্ট হয়ে থাকি।আর তাতেই আমরা তন্ময় হয়ে থাকি। এই খেলনা থেকে বিচ্যুত হলে, আমরা কান্নাকাটি জুড়ে দেই । আমরা কষ্ট পাই। কিন্তু বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই একই খেলনাতে আকর্ষণ আর থাকে না। ঠিক তেমনি কিছুদিন আমরা এই জগৎটাকে সত্য বলে মনে করি, আর তাতেই আমরা পরিপূর্ন, তন্ময় হয়ে থাকি। এই জগৎটাকে আমরা ধরতে চাই। এই জগৎটাকে ঘিরেই আমরা বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু জ্ঞান হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আর এই জগতের সঙ্গে আর কোনো আকর্ষণ অনুভব করি না। জগৎ তখন ওই ছেলেবেলার খেলনার মতো মনে হয়। আর হাসি পায়, এগুলো নিয়ে আমি একসময় খেলতাম। আনন্দ পেতাম। সত্য সবই, খেলনা যেমন সত্য, জগৎ সত্য, শুধু বদলে গেছে, আমার ধারণা, বদলে গেছে আমার মানসিকতা। এখন আমাদের কাছে ঈশ্বর সত্য বলে মনে হয়। আর ঈশ্বর সত্য বলে মনে হয় বলেই আমরা হৃদয় দিয়ে তাকেই ভালোবাসি, তাকেই অনুসরণ করি। যেমন এককালে খেলনাটাকে হৃদয় দিয়ে ভালো বাসতাম, যেমন একদিন এই জগৎটাকে হৃদয় দিয়ে ভালো বাসতাম, ঠিক তেমনি জ্ঞানের উন্মোচনের সাথে সাথে এখন আমরা ঈশ্বরকে ভালোবাসি। তাকে আমি কাছ ছাড়া হয়ে থাকতে পারি না।
তাই আমাদের যেটা দরকার, সেটা হচ্ছে সত্যের অনুসন্ধান করা। আর এই সত্য অনুসন্ধানের পথে আমরা যতদূর এগুবো, আমাদের চারিদিকের দৃশ্য বদলে যাবে। বদলে যাবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি। তাই আমাদের নিজেদের ধারণার উপরেই নির্ভর করছে, সৎ বস্তুর সম্পর্কে আমাদের ধারণা। শিশুর কাছে, পুতুলগুলো সত্য বলে প্রতিভাত হয়। সে তাকে জামা-কাপড় পড়ায়। তাদের বিয়ে দেয়। পুতুল নিয়ে সে আনন্দে মেতে থাকে। এমনকি পুতুল নিয়ে সে ঘুমুতে যায়। বড়রা বকলে তার কষ্ট হয়। কিন্তু সে যখন বড়ো হয়, তার নিজের মধ্যে ধারণার পরিবর্তন হয়। পুতুল তার কাছে আর জীবন্ত মনে হয় না। পুতুল তাকে আর আকর্ষণ করে না। জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। প্রত্যক্ষ এই জগৎ সম্পর্কেও ধীরে ধীরে তার জ্ঞানের পরিবর্তন হয়। আগে মাংস-মিষ্টিতে সে আকর্ষণ বোধ করতো। এখন সে নিরামিষ খায়। আসলে সেই সবুজ চশমা। যে রঙের চশমা যখন আমাদের চোখে লাগানো থাকে জগৎটাকে আমি সেই রঙের দেখতে থাকি। আসলে চশমাটা আমাদের চোখে। রঙ আমাদের চোখে লাগানো আছে, জগৎ যা ছিল তাই আছে। কেবল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে।
একটা সময় ভৌত জগৎকে আমাদের আধ্যাত্মিক জগৎ থেকে বেশী সত্য বলে মনে হয়। একটা সময় আমাদের এই শরীরটাকে আত্মা থেকে বেশী সত্য বলে মনে হয়। আসলে চেতন স্তর থেকে আমরা যত নিচে অবস্থান করি, ততই জগৎ, এই শরীর আমাদের কাছে সত্য বলে হয় । চেতন স্তর থেকে যত আমরা নিচে নাবতে থাকি, ততই আমাদের দেহ চেতনার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর ঠিক যখন এর উল্টোটা হয়, আমরা যখন আমাদের চেতন স্তরের মাত্রাকে ধ্যানের মাধ্যমে বৃদ্ধি করতে পারি, তখন আমাদের এই দেহ, এই বাহ্যিক জগৎ আমাদের কাছে গুরত্ত্ব হারিয়ে ফেলে।
জীবের গঠন তিনটি বিষয়ের দ্বারা হয়ে থাকে। মন-অহং-চিদাভাস। এই তিনটি আবার তিনটি গুনের সমাহার - সত্ত্ব, রজ, তম। এই তিন গুনের মিলনে জাত হচ্ছে মায়া। এই মনই অহং চেতনাকে জাগিয়ে তোলে এবং সেখানে ব্রহ্ম-জ্যোতিঃ প্রতিফলিত হয়। অহং চেতনা সম্বলিত এই প্রতিফলিত জ্যোতিঃ হচ্ছে জীবাত্মা। যখন উচ্চতর জ্ঞানের সাহায্যে এই প্রতিফলনকারী দর্পণটি বিনাশপ্রাপ্ত হয়, তখন ব্রহ্ম জ্যোতিঃ ব্রহ্মতে লিন হয়ে যায়। ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। তাই বলা হয়ে থাকে, গুণাতীত অবস্থায়, জীব ও ব্রহ্ম একই। যতদিন এই দর্পন অর্থাৎ অহং রয়েছে, ততদিন জীবের অস্তিত্ত্ব থাকে। অহং সীমার মধ্যে আবদ্ধ। ব্রহ্ম অসীম। অহংয়ের লোপ সাধনে অসীম ব্রহ্মই থাকে। তাই বলা হয়ে থাকে ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয় - একমেব-অদ্বিতীয়ম।SASANKA SEKHAR PEACE FOUNDATION - ETERNAL PEACE SEEKER
Информация по комментариям в разработке