প্রাচীন বাংলার জনপদ :
চতুর্থ শতক হতে গুপ্ত যুগ, গুপ্ত পরবর্তী যুগ, পাল, সেন প্রভৃতি আমলের উতকীর্ণ শিলালিপি ও সাহিত্য গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোর নাম পাওয়া যায়। এসব জনপদ ঠিক কোথায় কতখানি জায়গা জুড়ে ছিল তা বলা যায় না।
গৌড় :
গৌড় নামটি সুপরিচিত হলেও প্রাচীনকালে গৌড় বলতে ঠিক কোন অঞ্চলকে বোঝাত এ নিয়ে প্রচুর মতভেদ আছে। আর যে এলাকা গৌড় বলে অভিহিত হতো কেনই বা সে অঞ্চল এ নামে অভিহিত হতো আজ পর্যন্ত সেটাও সঠিকভাবে জানা যায় নি। পাণিনির গ্রন্থে সর্বপ্রথম গৌড়ের উল্লেখ দেখা যায়। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে গৌড় দেশের অনেক শিল্প ও কৃষিজাত দব্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্যাতসায়নের গ্রন্থেও তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে গৌড়ের নাগরিকদের বিলাস-ব্যসনের পরিচয় পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের শিলালিপি হতে প্রমাণিত হয় যে, সমুদ্র উপকূল হতে গৌড়দেশ খুব বেশি দূরে অবস্থিত ছিল না। ষষ্ঠ শতকে লেখা বরাহ মিহিরের বিবরণ হতে দেখা যায় যে, গৌড় অন্যান্য জনপদ, যথা: পুন্ড, বঙ্গ, সমতট থেকে আলাদা একটি জনপদ। ‘ভবিষ্য পুরাণ’-এ একে পদ্মা নদীর দক্ষিণে এবং বর্ধমানের উত্তরে অবস্থিত অঞ্চল বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ উক্তির সঙ্গে সপ্তম শতকের লোকদের বর্ণনার যথেষ্ট সামঞ্জস্য আছে। সপ্তম শতকে গৌড়রাজ শশাংকের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী কর্ণসুবর্ণ। আর শুধু বা শশাংকই কেন, পরবর্তীকালে আরও অনেকের রাজধানী ছিল এই গৌড়। পাল রাজাদের আমলে গৌড়ের নাম-ডাক ছিল সবচেয়ে বেশি। উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখন গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সামাজ্যের কেন্দস্থল হওয়ায় তার প্রতাপ ছিল অপ্রতিহত। পরবর্তীকালে পাল সামাজ্যের ভাগ্য পরিবর্তনের সাথে সাথে গৌড়ের ভাগ্যও পরিবর্তিত হয়ে যায়। গৌড়ের সীমা তখন সীমাবদ্ধ হয়ে আসে। আধুনিক মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানের কিছু অংশ গৌড়ের সীমানা বলে মনে করা হয়। সপ্তম শতকে গৌড়রাজ শশাংকের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ। মুসলমান যুগের শুরুতে মালদহ জেলার লক্ষণাবতী গৌড় নামে অভিহিত হতো। পরে গৌড় বলতে সমগ্র বাংলাকে বুঝাত।
বঙ্গ :
বঙ্গ একটি অতি প্রাচীন জনপদ। অতি প্রাচীন পুঁথিতে একে মগধ ও কলিঙ্গ জনপদের প্রতিবেশী বলা হয়েছে। মহাভারতের উল্লেখ হতে বুঝা যায় যে, বঙ্গ, পুন্ড, তামলিপ্ত ও সুহ্মের সংলগ দেশ। চন্দগুপ্ত, বিক্রমাদিত্য, চালুক্য রাজা ও রাষ্টকূটদের শিলালিপি এবং কালিদাসের গ্রন্থে এ জনপদের বর্ণনা পাওয়া যায়। বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বঙ্গ নামে একটি জনপদ গড়ে উঠেছিল। অনুমান করা হয়, এখানে ‘বঙ্গ’ নামে এক জাতি বাস করত। তাই জনপদটি পরিচিত হয় ‘বঙ্গ’ নামে। সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে মনে হয়, গঙ্গা ও ভাগিরথীর মাঝখানের অঞ্চলকেই বঙ্গ বলা হতো। পাল ও সেন বংশীয় রাজাদের আমলে বঙ্গের আয়তন সঙ্কচিত হয়ে পড়ে। একাদশ শতকে পাল বংশের শেষ পর্যায়ে বঙ্গ জনপদ দুভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তর বঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গ নামে পরিচিত হয়। পদ্মা ছিল উত্তরাঞ্চলের উত্তর সীমা, দক্ষিণের বদ্বীপ অঞ্চল ছিল দক্ষিণ বঙ্গ। পরবর্তীকালে কেশব সেন ও বিশরূপ সেনের আমলেও বঙ্গের দুটি ভাগ পরিলক্ষিত হয়। তবে এবার নাম আলাদÑ একটি ‘বিক্রমপুর’ ও অপরটি ‘নাব্য’। প্রাচীন শিলালিপিতে ‘বিক্রমপুর’ ও ‘নাব্য’ নামে বঙ্গের দুটি অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়। বর্তমান বিক্রমপুর পরগনা ও তার সাথে আধুনিক ইদিলপুর পরগনার কিয়দংশ নিয়ে ছিল বিক্রমপুর। নাব্য বলে বর্তমানে কোন জায়গার অস্তিত্ব নেই। ধারণা করা হয়, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালীর নিম্ন জলাভূমি এ নাব্য অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বৃহত্তর বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ জেলার পশ্চিমাঞ্চল, ঢাকা, ফরিদপুর, কষ্টিয়া, বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালীর কিছু অংশ নিয়ে বঙ্গ গঠিত হয়েছিল। ‘বঙ্গ’ থেকে ‘বাঙালি’ জাতির উতপত্তি ঘটেছিল।
পুন্ড্রু:
প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো পুন্ড্রু। বলা হয় যে, ‘পুন্ড্রু’ বলে এক জাতি এ জনপদ গড়ে তলেছিল। বৈদিক সাহিত্য ও মহাভারতে এ জাতির উল্লেখ আছে। পুন্ড্রুদের রাজ্যের রাজধানীর নাম পুন্ড্রুনগর। পরবর্তীকালে এর নাম হয় মহাস্থানগড়। সম্ভবত মৌর্য সমাট অশোকের রাজত্বকালে (খিঃ পূ: ২৭৩-২৩২ অব্দ) প্রাচীন পুন্ড্রু রাজ্য স্বাধীন সত্তা হারায়। সমৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে তা পুন্ড্রুবর্ধনে রূপান্তরিত হয়েছে। সে সময়কার পুন্ড্রুবর্ধন অন্তত বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। রাজমহল-গঙ্গা-ভাগীরথী হতে আরম্ভ করে করতোয়া পর্যন্ত মোটামুটি সমস্ত উত্তর বঙ্গই বোধহয় সে সময় পুন্ডবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেন আমলে পুন্ড্রুবর্ধনের দক্ষিণতম সীমা পদ্মা পেরিয়ে একেবারে খাড়ি বিষয় (বর্তমান চব্বিশ পরগনার খাড়ি পরগনা) ও ঢাকা-বরিশালের সমুদ তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বগুড়া হতে সাত মাইল দূরে মহাস্থানগড় প্রাচীন পুন্ড্রুবর্ধন নগরীর ধ্বংসাবশেষ বলে পন্ডিতেরা অনুমান করেন। প্রাচীন সভ্যতার নির্দশনের দিক দিয়ে পুন্ড্রুই ছিল প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। বাংলাদেশে প্রাপ্ত পাথরের চাকতিতে খোদাই করা সম্ভবত প্রাচীনতম শিলালিপি এখানে পাওয়া গেছে।
হরিকেল :
সাত শতকের লেখকেরা হরিকেল নামে অপর এক জনপদের বর্ণনা করেছেন। চীনা ভ্রমণকারী ইতসিং বলেছেন, হরিকেল ছিল পূর্ব ভারতের শেষ সীমায়। আবার কারো কারো লিপিতে হরিকেলের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে বর্তমান চট্টগ্রামেরও অংশ খুঁজে পাওয়া যায়। সমস্ত তথ্য পর্যালোচনা করে ধরে নেওয়া যায় যে, পূর্বে শ্রীহট্ট (সিলেট) থেকে চট্টগ্রামের অংশ বিশেষ পর্যন্ত হরিকেল জনপদ বিস্তৃত ছিল। যদিও মধ্যখানে সমতট রাজ্যের অবস্থিতি ছিল- যা কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। আসলে তখন জনপদের কোথাও কোথাও বেশ শিথিল অবস্থা বিরাজ করছিল। তা ছাড়া বঙ্গ, সমতট ও হরিকেল- তিনটি পৃথক জনপদ হলেও এরা খুব নিকট প্রতিবেশি হওয়ায় কখনো কখনো কোনো কোনো এলাকায় অন্য জনপদের প্রভাব বিরাজ করত বলে ধারণা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, সপ্তম ও অষ্টম শতক হতে দশ ও এগারো শতক পর্যন্ত হরিকেল একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল।
Информация по комментариям в разработке