হংদু কে-৮ / কে-৮ডব্লিউ প্রশিক্ষণ ও হালকা যুদ্ধবিমান – বাংলাদেশের আকাশে আধুনিক প্রশিক্ষণের প্রতীক
হংদু কে-৮ বা কারাকোরাম-৮ (Hongdu K-8 / Karakoram-8) একটি দুই আসনের জেট ট্রেনার এবং হালকা যুদ্ধবিমান, যা চীন ও পাকিস্তানের যৌথ সহযোগিতায় তৈরি করা হয়েছে। এই বিমানটি মূলত এমন দেশগুলোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যারা আধুনিক জেট প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চায় কিন্তু ব্যয়বহুল পশ্চিমা ট্রেনার বিমানের সামর্থ্য রাখে না। হংদু এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন (চীন) এবং পাকিস্তান এরোস্পেস কমপ্লেক্স (PAC) যৌথভাবে ১৯৮৭ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করে, এবং ১৯৯০ সালের ২১ নভেম্বর প্রথম উড্ডয়ন সম্পন্ন হয়। এরপরে ১৯৯৪ সালে কে-৮ আনুষ্ঠানিকভাবে পরিষেবায় অন্তর্ভুক্ত হয় এবং দ্রুতই আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ বিমানের বাজারে সফলতা অর্জন করে।
কে-৮ বিমানটি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সীমিত যুদ্ধ অভিযানে ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পাইলটদের উন্নত যুদ্ধবিমানে যেমন জেএফ-১৭ থান্ডার, এফ-৭ বা এফ-১৬-এ রূপান্তরের জন্য প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী পর্যায়ের প্রশিক্ষণ প্রদান করা। বিমানে দুটি আসন থাকে — একজন প্রশিক্ষক পেছনে এবং একজন প্রশিক্ষণার্থী সামনে। উভয় ককপিটেই আধুনিক যন্ত্রপাতি, গ্লাস ডিসপ্লে এবং ইজেকশন সিট রয়েছে, যা প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
এর শক্তিশালী টার্বোফ্যান ইঞ্জিন বিমানটিকে ৮০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতি পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম করে। চীনা সংস্করণে সাধারণত Ivchenko AI-25TLK ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়, আর পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশ আমেরিকান Honeywell TFE731-2A-2A ইঞ্জিন ব্যবহার করে। সর্বোচ্চ উড্ডয়ন উচ্চতা প্রায় ১৩,০০০ মিটার এবং পরিসর প্রায় ২,২০০ কিলোমিটার। কম জ্বালানি খরচ, সহজ রক্ষণাবেক্ষণ ও দীর্ঘমেয়াদি অপারেশনাল কার্যকারিতা এই বিমানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
হংদু কে-৮ডব্লিউ (K-8W) হলো এই সিরিজের উন্নত সংস্করণ, যা বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে সরবরাহ করা হয়েছে। কে-৮ডব্লিউ তে আধুনিক হেড-আপ ডিসপ্লে (HUD), ডিজিটাল মিশন কম্পিউটার এবং মাল্টি-ফাংশন ডিসপ্লে (MFD) যুক্ত করা হয়েছে, যা প্রশিক্ষণার্থীদের উন্নত প্রযুক্তির বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রদান করে। এর ফলে ভবিষ্যতে উন্নত যুদ্ধবিমান চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন আরও সহজ হয়।
অস্ত্র বহনের দিক থেকেও কে-৮ একটি উল্লেখযোগ্য বিমান। এতে পাঁচটি হার্ডপয়েন্ট রয়েছে—চারটি ডানার নিচে এবং একটি ফিউজেলাজের নিচে—যেখানে সর্বোচ্চ ৯৪৩ কেজি পর্যন্ত অস্ত্র বহন করা যায়। এতে সাধারণত ২৩ মিমি কামান পড, বোমা, রকেট এবং অতিরিক্ত জ্বালানির ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। ফলে এটি শুধু প্রশিক্ষণ নয়, বরং হালকা আক্রমণাত্মক অভিযানে, সীমান্ত নজরদারি ও গ্রাউন্ড সাপোর্ট মিশনে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বর্তমানে কে-৮ডব্লিউ সংস্করণ পরিচালনা করছে। এই বিমান যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের বিমান প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা আরও আধুনিক হয়েছে। আগে যেখানে উন্নত পর্যায়ের প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন হতো, এখন দেশেই আধুনিক প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কে-৮ডব্লিউ বিমানের অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে এবং এটি এখন প্রশিক্ষণ ছাড়াও সীমিত যুদ্ধ মিশনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কে-৮ডব্লিউ বিমানের নির্ভরযোগ্যতা ও পারফরম্যান্স বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী প্রমাণিত হয়েছে। এর রক্ষণাবেক্ষণ সহজ, জ্বালানি খরচ কম, এবং দীর্ঘ সময় আকাশে টহল দিতে সক্ষম। এটি দেশের তরুণ পাইলটদের বাস্তব যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য আদর্শ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে।
বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত ৫০০-রও বেশি কে-৮ ও এর বিভিন্ন সংস্করণ তৈরি হয়েছে এবং এটি ১৫টিরও বেশি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। মিশর, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে, বলিভিয়া ও সুদানসহ বহু দেশ এই বিমানের ব্যবহারকারী। অনেক দেশ এটি স্থানীয়ভাবে সংযোজন বা উৎপাদন করছে, যা চীনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার একটি বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হয়।
মিয়ানমারের মতো কিছু দেশ এটি সরাসরি যুদ্ধ মিশনে ব্যবহার করেছে। যদিও কে-৮-এ রাডার নেই, ফলে এটি আকাশযুদ্ধে সীমিত ভূমিকা পালন করতে পারে, তবে ভূমি আক্রমণ ও হালকা যুদ্ধ মিশনে এটি অত্যন্ত কার্যকর।
চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই বিমান প্রকল্প প্রযুক্তি বিনিময় ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলিকে স্বল্প ব্যয়ে আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা প্রদান করছে, যা সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সব মিলিয়ে, হংদু কে-৮ এবং এর উন্নত সংস্করণ কে-৮ডব্লিউ বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। এটি সাশ্রয়ী মূল্যে আধুনিক প্রযুক্তি, নির্ভরযোগ্য পারফরম্যান্স এবং বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করছে। প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ উভয় ক্ষেত্রেই এর অবদান বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করেছে। ভবিষ্যতে এই বিমান দেশের প্রতিরক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকবে, যা প্রমাণ করে যে হংদু কে-৮ কেবল একটি প্রশিক্ষণ বিমান নয়, বরং বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক।
হংদু কে-৮, কে-৮ডব্লিউ, কারাকোরাম-৮, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, জেট ট্রেনার, লাইট অ্যাটাক এয়ারক্রাফট, Hongdu K-8 Bangladesh, K-8W Bangladesh Air Force, PAC Kamra, চীন-পাকিস্তান বিমান প্রকল্প, সামরিক প্রশিক্ষণ বিমান, Bangladesh Air Force Trainer Jet, K-8 Aircraft
Информация по комментариям в разработке