বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণের সাংবিধানিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অবস্থা
কার্যনির্বাহী সারসংক্ষেপ:
এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ি জনগণের সাংবিধানিক মর্যাদা, বিশেষ প্রশাসনিক কাঠামো, ভূমি বিরোধ ও সামরিকীকরণের মতো চলমান চ্যালেঞ্জ এবং জটিল রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে একটি বিশদ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। এতে সাংবিধানিক স্বীকৃতির সীমাবদ্ধতা, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির অসম্পূর্ণ বাস্তবায়ন, এবং এর ফলস্বরূপ সৃষ্ট প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংকটগুলো তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে পার্বত্য অঞ্চলের বিশেষ প্রশাসনিক সংস্থাগুলোর গঠন ও ক্ষমতা পর্যালোচনা করা হয়েছে, বিশেষ করে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের অকার্যকারিতা, যা এই অঞ্চলের উত্তেজনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া, সামরিক বাহিনীর দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি এবং বেসামরিক প্রশাসনের উপর তার প্রভাব, এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিভাজন ও জাতীয় রাজনীতিতে তাদের প্রান্তিক অবস্থানও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সবশেষে, এই জটিল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সাংবিধানিক সংস্কার, প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে একটি টেকসই সমাধানের পথনির্দেশ করা হয়েছে।
অধ্যায় ১: সাংবিধানিক কাঠামো এবং পরিচয়ের প্রশ্ন
এই অধ্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের আইনগত ও সাংবিধানিক অবস্থান বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেখানে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এবং পরিচয় ও অধিকার সংক্রান্ত গভীর রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যকার টানাপোড়েনকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে।
১.১. সাংবিধানিক স্বীকৃতি: অনুচ্ছেদ ২৩ক এবং এর সীমাবদ্ধতা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২৩ক সংযোজন করা হয়, যা দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ । এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: "রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন" । এই বিধানটি দেশের জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রথমবারের মতো একটি সাংবিধানিক পরিচিতি প্রদান করে।
তবে, এই অনুচ্ছেদের পরিধি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি মূলত "সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য" সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করে, কিন্তু ভূমি বা রাজনৈতিক অধিকারের মতো মৌলিক বিষয়গুলোকে সরাসরি সম্বোধন করে না। এটি রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন বা সহজাত সার্বভৌমত্ব স্বীকার না করে বরং রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সাংস্কৃতিক সুরক্ষার একটি কাঠামো প্রদান করে । এই বিধানটি সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক নীতির সাথে মিলিয়ে পাঠ করা আবশ্যক, যেমন আইনের দৃষ্টিতে সমতা (অনুচ্ছেদ ২৭), ধর্ম ইত্যাদি কারণে বৈষম্যহীনতা (অনুচ্ছেদ ২৮), এবং সরকারি নিয়োগে সুযোগের সমতা (অনুচ্ছেদ ২৯) । কিন্তু এই সর্বজনীন অধিকার এবং পাহাড়ি জনগণের নির্দিষ্ট বঞ্চনার অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ব্যবধান বিদ্যমান।
১.২. 'আদিবাসী' বনাম 'উপজাতি' বিতর্ক: আইনগত ও রাজনৈতিক তাৎপর্য
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পরিচয়ের সংকটটি 'আদিবাসী' এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহৃত 'উপজাতি', 'ক্ষুদ্র জাতিসত্তা' ইত্যাদি পরিভাষার মধ্যকার বিতর্কে মূর্ত হয়ে উঠেছে । পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতির দাবিটি শুধুমাত্র একটি পারিভাষিক বিষয় নয়, বরং এর সাথে গভীর আইনগত ও রাজনৈতিক তাৎপর্য জড়িত। এই স্বীকৃতি মূলত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অধিকারের দাবি, বিশেষ করে 'জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র' (UNDRIP) অনুযায়ী, যেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রথাগত ভূমির উপর অধিকারের কথা বলা হয়েছে ।
বিপরীতে, বাংলাদেশ সরকার সংবিধান এবং 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০'-এর মতো বিভিন্ন আইনে 'আদিবাসী' শব্দের পরিবর্তে 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী' বা 'উপজাতি'-এর মতো বিকল্প পরিভাষা ব্যবহার করে । এর মূল কারণ হলো 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতি দিলে যে আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়, তা এড়িয়ে যাওয়া। রাষ্ট্রের এই অবস্থানটি পাহাড়ি জনগণের সাথে недоверие বা অবিশ্বাসের একটি কেন্দ্রীয় কারণ এবং তাদের মৌলিক অধিকারের সংগ্রামের পথে একটি বড় বাধা। সাংবিধানিক কাঠামোটি একটি সতর্ক রাজনৈতিক পদক্ষেপের প্রতিফলন, যেখানে সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি (অনুচ্ছেদ ২৩ক) প্রদান করেও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী 'আদিবাসী' পরিচয়কে অস্বীকার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র একদিকে বৈচিত্র্যকে ধারণ করার বার্তা দেয়, অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ও সম্পদের উপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন কোনো অধিকার স্বীকার করা থেকে বিরত থাকে। এই আইনি ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।
১.৩. সংবিধানের সংখ্যাগুরুকেন্দ্রিক কাঠামোর সমালোচনা
বিভিন্ন সমালোচকের দৃষ্টিতে, বাংলাদেশের সংবিধান তার কাঠামোগত দিক থেকে সংখ্যাগুরুকেন্দ্রিক, যা মূলত বাঙালি জাতিসত্তার উপর ভিত্তি করে রচিত । এমন মতও প্রচলিত আছে যে, এই সংবিধান "পুরুষতান্ত্রিক, বাঙালির, এবং মুসলমানের", যেখানে অন্যান্য জাতি, ভাষা বা ধর্মের অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই । এই প্রেক্ষাপটে, পাহাড়ি নেতারা সংবিধানে দেশের প্রতিটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নাম স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন, যা তাদের অন্তর্ভুক্তির অনুভূতিকে শক্তিশালী করবে এবং শুধুমাত্র একটি সাধারণ শ্রেণিবিভাগের ঊর্ধ্বে গিয়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে ।
সংবিধানে সুনির্দিষ্ট রক্ষাকবচের এই অভাব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর জন্য এক ধরনের "অস্তিত্বের সংকট" তৈরি করেছে, যা সমাধানের জন্য একটি স্থায়ী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন । যেহেতু দেশের সর্বোচ্চ আইন তাদের পরিচয় ও অধিকারের একটি গ্রহণযোগ্য ভিত্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে, পাহাড়ি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মূল দাবি (যেমন ভূমি অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন) আদায়ের জন্য অনেক সময় আনুষ্ঠানিক আইনি কাঠামোর বাইরে বা তার বিপরীতে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। - বাকিটা বিস্তারিত ফেইসবুক এ / 1cc1qehhks
Информация по комментариям в разработке