Скачать или смотреть বাংলাদেশের নদী পথের যাতায়াত/Travel on the river Bangladesh

শীতের শুরু, হালকা কুয়াশা ঢাকা ভোর। ঢাকার সদরঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে লঞ্চ ছাড়বে ঠিক সকাল সাতটায়। মায়ের সঙ্গে অনেকদিন পর গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি আমি, নীলা। জীবনে প্রথমবার লঞ্চে চড়বো—উত্তেজনা আর ভয় একসাথে কাজ করছিল।

সদরঘাট যেন এক আলাদা জগৎ—লোকজনের হাঁকডাক, নানা পণ্যের গন্ধ, চায়ের দোকানের ধোঁয়া, আর নদীর ওপরে সারি সারি লঞ্চ। আমাদের লঞ্চের নাম "অভিযান-৭"। লঞ্চটায় পা রাখতেই মনে হলো, একটা ভাসমান ছোট শহরে ঢুকে পড়েছি।

দ্বিতীয় তলায় একটি জানালার পাশে সিট পেয়ে আমরা বসে পড়লাম। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “দেখবি, নদীপথের যাত্রা জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে।” আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম—পদ্মা ও মেঘনার মিলনস্থলে অসীম জলরাশি আর আকাশের প্রতিচ্ছবি। লঞ্চ ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল, ঢাকার কোলাহল পেছনে ফেলে শান্ত জলের বুকে ভেসে চলা।

লঞ্চের ডেকে উঠে পড়ি একসময়। হালকা বাতাসে চুল উড়ে যাচ্ছে, আর দূরের নৌকাগুলো যেন জলরঙের ছবির মতো। কিছুটা দূরে একটা মাছ ধরার ট্রলার চলে গেল। নদীর বুক চিরে ছুটে চলা সেই ট্রলারের পেছনে জলের সাদা ফেনা রেখে যাওয়া ছিল অপূর্ব এক দৃশ্য।

লঞ্চে নানা রকমের মানুষ—ছাত্র, কৃষক, ব্যবসায়ী, নারী-শিশু সবাই মিলে এক মানবিক পরিবেশ। একজন বয়স্ক চাচা গল্প শুরু করলেন—"এই লঞ্চেই বিয়ে করে আমার স্ত্রীকে এনেছিলাম ৩৫ বছর আগে!" চারপাশে হাসির রোল পড়ে গেল। তখন বুঝলাম, নদীপথ কেবল যাতায়াত নয়, মানুষের জীবনের গল্প বহন করে।

একসময় লঞ্চ একটা মাঝি ঘাটে থামে, কয়েকজন লোক নামেন, কেউ ওঠেন। একজন স্থানীয় মহিলা আমাদের পাশে বসে সজল চোখে বলেন, “মা অসুস্থ, দেখতে যাচ্ছি।” নদী যেমন জীবন দেয়, তেমনি জীবনের সব অনুভূতির সাথেও জড়িয়ে থাকে।

দুপুরে লঞ্চের ক্যান্টিন থেকে ভাত-মাছ নিলাম। সাধারণ খাবার, কিন্তু নদীর বুকে বসে খাওয়ার আনন্দ একেবারে অন্যরকম। দূরের গাঁয়ের সবুজ মাঠ, তাল-খেজুর গাছ, আর নদীপাড়ের পাখির ডাক—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, কবিতার ভিতর দিয়ে চলেছি।

শেষ বিকেলে যখন বরিশালের ঘাট দেখা যায়, তখন মনটা হঠাৎ ভারী হয়ে উঠলো। এতো দ্রুত যেন শেষ হয়ে গেল এই সুন্দর যাত্রা! মনে মনে ভাবলাম, নদী যেন একটি গল্পকার—প্রতিটি ঢেউতে বহে যায় হাজারো গল্প।

বাংলাদেশের নদীপথ শুধু পরিবহণ নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, অনুভব, এবং স্মৃতির ধারক। সেই যাত্রার দিনটা আমার মনে থাকবে আজীবন—নদীর কোল ঘেঁষে ভেসে চলা এক স্বপ্নময় অভিজ্ঞতা।