ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আলোর ইশকুলের আয়োজন। অনলাইন আলোচনা: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের নারী। ৩১ অক্টোবর ২০২০, শনিবার।
সংগ্রহ - বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র Bishwo Shahitto Kendro
Link - / bishwo.shahitto.kendro.official.page
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কর্ম-তৎপরতাকে প্রধানত চার শ্রেণিতে চিহ্নিত করা যায় –
১. সমাজসংস্কারের প্রয়োজনে রচনা : বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫), বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৫৫), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১৮৭১), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার – দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৭৩), বাল্যবিবাহে দোষ বেনামিতে প্রকাশিত : অতি অল্প হইল (১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), বিধবাবিবাহ ও যশোহর হিন্দুধর্মরক্ষিণী সভা (১৮৮৪)।
২. শিক্ষার প্রয়োজনে রচিত পাঠ্যপুস্তক : বর্ণপরিচয় – প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৫), ঋজুপাঠ – প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ভাগ (১৮৫১, ১৮৫২), সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১), সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৪), কথামালা (১৮৫৬), চরিতাবলী (১৮৫৬), মহাভারত-উপক্রমণিকা ভাগ (১৮৬০), আখ্যানমঞ্জুরী (১৮৬৩), শব্দমঞ্জুরী (১৮৬৪), বোধোদয় (১৮৫১)।
৩. অনুবাদমূলক গদ্য সাহিত্য : বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৮), শকুন্তলা (১৮৫৪), সীতার বনবাস (১৮৬০), ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯), বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮), জীবনচরিত (১৮৪৯)।
৪. আত্মজীবনী ও ব্যক্তিগত গদ্য-পদ্য রচনা : বিদ্যাসাগরচরিত – স্বরচিত (১৮৯১), নিষ্কৃতিলাভ প্রয়াস (১৮৮৮), সংস্কৃত রচনা (১৮৮৯), শ্লোকমঞ্জুরী (১৮৯০), পদ্যসংগ্রহ – প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ (১৮৮৮, ১৮৯০) বিদ্যাসাগরের উইল (১৮৭৫) চিঠিপত্র।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি মনে বারংবার উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড় লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে, তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন। বিদ্যাসাগরের জীবনীতে এই অনন্যসুলভ মনুষ্যত্বের প্রাচুর্যই সর্বোচ্চ গৌরবের বিষয়।’ (রবীন্দ্রনাথ ১৯০৯ : ৭) এই ‘মনুষ্যহিত’ ‘দয়া’ উপনিবেশের ‘লিবারেল হিউম্যানিজমের’ প্রভাব। এছাড়া জেদ, দৃঢ়তা, সাহস, সংকল্প, আত্মমর্যাদাবোধ তাঁর চরিত্রকে মহৎ করেছে। নিঃস্ব ব্যক্তির অভাব, বিপন্ন ব্যক্তির বিপদ, তিনি একাই ঘুচাতে চাইতেন। সেটা তাঁর নিঃসন্দেহে মহৎ গুণ। কিন্তু উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক জীবনে যেসব গুরুতর সংকট বিরাজমান ছিল, যেমন – বর্ণপ্রথা, কৃষক-শ্রমিক শোষণ, ভূ-রাজস্বের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা, নীলবিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। টুলো ব্রাহ্মণের সন্তান যখন শাস্ত্র ঘেঁটে প্রমাণ করলেন, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত – শাস্ত্রের এই পুনর্বিচার, শাস্ত্রবিধিরক্ষিত হিন্দুসমাজের ওপর একটা বড় ধরনের আঘাত হয়ে আসে। এই বৈপ্লবিক আঘাত আরোপণমূলক নয়, বিদ্যাসাগরের আঘাত ছিল ভেতর থেকে। তখন গোঁড়া ব্রাহ্মণরা গোপনে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-গালি কিছুই তাঁকে দৃঢ় সংকল্প থেকে টলাতে পারেনি। বহুবিবাহবিরোধী পুস্তিকায় তিনি ব্রাহ্মসমাজের কৌলীণ্যপ্রথার ইতিহাস উদ্ঘাটন করে প্রমাণ করেন, তা অশাস্ত্রীয়। কায়স্থ সমাজের আচারও তিনি বিচারে আনেন। দুর্ভাগ্যবশত লোকাচারের সঙ্গে তাঁর মৌলিক বিরোধিতা ঘটে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ রোধ, নারীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদান, কোনোটাই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। চটিজুতা ও মোটাধুতি পরে তিনি সকলের কাছে সম্মান লাভ করেছিলেন। তবু উনিশ শতকের কলকাতায় বিদ্যাসাগর একা, নিঃসঙ্গ, স্বজাতি সোদর, সহযোগী, তাঁর মহৎ কাজের কোনো উত্তরাধিকারী কেউ ছিল না। তিনি পরোপকার করে কৃতঘ্নতা পেয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকালে যা করতে চেয়েছেন, সহায়তা পাননি, পদে পদে বাধা পেয়েছেন। সংস্কৃত কলেজে রসময় দত্তের সঙ্গে মতান্তরে (১৮৫০) পদত্যাগ করেন, শিক্ষাবিভাগের ময়ট সাহেবের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে (১৮৫৮) চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন, ‘আত্মীয়-বান্ধবেরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, তোমার চলিবে কী করিয়া। তিনি বলিলেন ‘আলু-পটল বেচিয়া, মুদির দোকান করিয়া দিন চালাইব।” (রবীন্দ্রনাথ ১৯০৯ : ৩১)। হ্যালিডে সাহেব বিদ্যাসাগরকে পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু বিদ্যাসাগর পদত্যাগপত্র সংশোধন করতে রাজি হননি। তিনি লিখেছেন –
I thought it possible you might be asked to explain the cause of your dissatisfaction with the administration of the depertment and as you expressed an insuperable objected to do this in a public form I suggested that it must be better to omit what you were unwilling to account for and merely allude to your illness which though not the sole was certainly a sufficient reason for resignation.
কারণ, ‘বিদ্যাসাগর বাঙালি সমাজের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ইংরেজের রাষ্ট্রশক্তিকে, যাতে বাঙালি সমাজে নতুন গতিবেগের ধাক্কা লাগাতে পারেন। সে-উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকারের ওপর তিনি ভরসা করেছিলেন। সরকার বলতে প্রথম দিকে হয়তো লাটসাহেবের ব্যক্তিগত শাসন, সুতরাং বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত বন্ধুতাই সে-সরকারে অনেকটা প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে তো সরকার তার নিজের অনিবার্য চেহারাটি পাচ্ছে আর বিদ্যাসাগর সেই ব্যুরোক্রেসির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে গেছেন। তার ভরসাস্থল হয়ে উঠছে প্রতিপক্ষ।’ (দেবেশ ২০২০ : ৬০) বিদ্যাসাগরের কণ্ঠস্বর ক্রমেই অভিমানী হয়ে ওঠে এবং এই অভিমান সত্য হয়। ইংরেজ সমর্থনে বাংলার শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা, সমাজসংস্কারের যে-স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষতাকে কেন্দ্র করে, মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে তাকে সে কর্মক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াতে হলো? এটা কি বিদ্যাসাগরের দুর্ভাগ্য? নাকি বাংলার রেনেসাঁসের নিয়তি? এই প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
Информация по комментариям в разработке