পন্ডিতদের অংকের হিসেব এবং পান্ডিত্য হযবরল এর কাক্কেশ্বর কুচকুচের থেকে বেশি নয়। কাজেই তাঁরা যে কোনও নির্বাচনে নিদান হেঁকে আপাতত আকর্ষণ বাড়ানোর কায়দাটা বুঝে ফেলেছেন। এমন নয় যে কোনও নির্বাচনেই তার ফলাফল আগে থেকে বোঝা যায় না। যায় বৈকি, এক অত্যন্ত নড়বড়ে বিরোধী, আর প্রবল সংগঠনের ক্ষমতায় বলীয়ান দুই দলের লড়াই এ কে জিতবে তা জানতে রাজনৈতিক পন্ডিত হয়ে হয় না। গ্রাম বাংলা ঘুরুন, যে কোনও মানুষ, সে সরকারি দলের সমর্থক নয়, তারাও বলছে তৃণমূল আবার সরকারে ফিরবে। কেন? কী ভাবে? ঐ যে বাংলার ভোটে দলীয় সংগঠনের ভূমিকা, সেটা নিয়ে কিঞ্চিত নাড়াঘাঁটা করলেই বোঝা যায়। কিন্তু বিহার? সে এক বিশাল গোলকধাঁধা। জাতপাতের এক জটিল সমীকরণ, পিছিয়ে পড়ার মধ্যেও আবার বেশি পিছিয়ে পড়া, আবার তার মধ্যেও মাল্লা দের সঙ্গে নিষাদের তফাৎ, প্রায় ক্যালকুলাসের জটিলতা। কাজেই সেখানে ইনিই জিতছেন, উনিই হারছেন বলা অসম্ভব। কোনও নতুন ছবি উঠে আসবে? নাকি পুরনো ছবিই বরকরার থাকবে তা বলা প্রায় অসম্ভব। এই যে দেখুন না সেই পন্ডিতির উদাহরণ। বিহারে নাকি এবারে বাম্পার ভোট পড়েছে, আর বিরাট ভোট পরা মানেই নাকি সরকারি দলের সাফায়া, এসব নিয়ে তেনারা তক্তা তক্তা লিখেও ফেলেছেন। একটা সহজ সোজা হিসেব তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে গেছে, বা সেসব হিসেব করার কোনও জ্ঞানবুদ্ধি তাঁদের নেই বা ছিল না। গতবারের থেকে ৮% নাকি বেশি ভোট পড়েছে, তাই নিয়ে হই হই চিৎকার। মাথাতেও নেই যে এবারে ভোটার তালিকাতে ৪৬ লক্ষ ভোটার নেই। শেষ সংশোধিত ভোটার তালিকাতে ৭.৪২ কোটি ভোটার আছে। তার আগে ৭.৮৮ কোটি ভোটার ছিল। গত ২০২০ তে ভোট পড়েছিল ৫৭.২৯% ভোট, মানে ভোট দিয়েছিল ৪.৫১ কোটি মানুষ। এবারে ৬৫% ভোট দিয়েছেন, মানে ৪.৮২ কোটি মানুষ ভোট দিয়েছেন। গতবারের ভোটে পলায়ন বা মাইগ্রেশন এত বড় ইস্যু ছিল না, আর ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের ফলে মানুষের ভোট নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে, ভোট না দিলে নাম কাটা যাবে এই হাওয়া উঠেছে আর এক নিষ্ক্রিয় ভোটারদের পিকের ভোকাল টনিক জাগিয়ে তুলেছে। আর এই সব মিলিয়ে মাত্র ৩০ লক্ষের মত মানুষ বেশি বুথে এসেছেন, তা নাকি পরিবর্তনের জন্য। বিহারে এ তাবৎ ভোটের পরিসংখ্যান বলছে ৬ বার ভোট বেড়েছে, কিন্তু মাত্র ২ বার জামানা পাল্টেছে। কাজেই ১) বিরাট ভোট পড়েছে তা নয়, আগের বারের চেয়ে হিসেব করলে ৩% এর মত মানুষ বেশি ভোট দিয়েছেন। ২) ভোট বেশি পড়লেই জামানা বদলাবে এরকম পন্ডিতি ফলানোর কোনও মানেই নেই। তাহলে? তাহলে আসুন বরং জটিলতার হিসেবটা করি। গতবারে নিতীশ – বিজেপির ভোট ছিল ১) নিতীশের মহিলা ভোট। ২) নিতীশের কুর্মি কৈরি, ইবিসি ভোট। ৩) বিজেপির বেনিয়া উচ্চবর্ণের ভোট। ৪) জঙ্গলরাজের ভয়ে সাধারণভাবে শান্তিতে থাকার চাহিদা নিয়ে মধ্য বিত্ত, উচ্চবিত্তের ভোট। একটা ভালো ভোট কেটেছিল চিরাগ পাশওয়ান, তার দল এল জে পি রামবিলাস। তারা আসন পায়নি কিন্তু ৫.৬৬% ভোট পেয়েছিল, ৯ টা আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। কাজেই এবারে সেই ভোট কিন্তু জুড়বে এন ডি এর গতবারের ভোটের সঙ্গে। যা বিরাট ফারাক করে দিতেই পারে। কিন্তু কিছু ভোট বাদও যাবে। কেন? ১) এবারে পলায়ন বা মাইগ্রেশন একটা বিরাট ইস্যু, যা এন ডি এর বিরুদ্ধে যাবে, সেই ভোট এর বেশিভাগতাই যাবে পিকের দিকে। ২) মদ্যপান বন্ধে প্রাথমিক সুবিধে যে মহিলারা পেয়েছিলেন, যে ভাবে গার্হস্থ হিংসা কমেছিল তার ছবি এখন এক্কেবারে বদলে গেছে, ঘরের দরজাতে এসে মদ ডেলিভারি দিচ্ছে, গার্হস্থ হিংসা জানাজানি হলে ঘরে রোজগার করা সেই বর, বাবা, দাদা কে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সবমিলিয়ে সেই মহিলারা এখন উলটো গাইছেন। ৩) এই ক বছরে এক সাঙ্ঘাতিক বেকারত্ব বেড়েছে, সেখানে তেজস্বী যাদবের সবঘরে একজন সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দাগ কেটেছে। ৪) এর আগে সামাজিক ন্যায়ের কথা বলতো মহাগটবন্ধন আর তার জবাবে উন্নয়ন আর বিকাশের কথা একচেটিয়াভাবেই বলতো এন ডি এ, বিজেপি, নিতীশকুমার, এখন সেই কথা আরও জোরে বলছেন পিকে, শহরাঞ্চলে তাঁর কথা শুনতে ভিড় হচ্ছে, এদিকে শহরাঞ্চলই বিজেপির বিরাট গড়, সেখানে পিকে সিঁধ কাটছেন। ওদিকে মহাগটবন্ধনের ভোট ছিল খুব পরিস্কার ১) আর জে ডির মুসলমান যাদবের ভোট। ২) বামেদের পকেটের ভোট যাতে মূলত দলিতি পিছিয়ে পড়া মানুষের ভোট আছে। ৩) কংগ্রেসের সামান্য পকেট ভোট, যাতে কিছুটা উচ্চবর্মণের ভোট আছে। এবারে এর সঙ্গে জুড়বে ১) মুকেশ সাহনির বিকাশশীল ইন্সান পার্টির ভোট, মাল্লাদের প্রায় আড়াই শতাংশ ভোট আছে, নিষাদদের জুড়ে নিলে সেই ভোট প্রায় ৫ শতাংশ। ২) মুকেশ সাহনি একজন ইবিসি, আর তাঁকে উপমূখ্যমন্ত্রী করা হবে বলে জানানো হয়েছে, কাজেই ইবিসিদের আরও কিছু অংশের ভোট জুড়ে যেতেই পারে। ৩) জুড়বে ইন্ডিয়ান ইনক্লুসিভ পার্টির আই পি গুপ্তার ভোট, এই দলের নাম খুব বেশি লোকজন শোনেন নি, তাহলে এঁদের নাম আসছে কেন? কারণ বিহারে ভোট্টা হয় জাতি পরিচিতির ওপরে, এই আই পি গুপ্তা তাঁতি – পান জাতের লোকজনকে রিপ্রেসেন্ট করেন, কাজেই তাদের হাতে থাকা প্রায় দেড় শতাংশ ভোট এবারে মহাগটবন্ধনের দিকে আসতেই পারে। একদা কংগ্রেসী নেতা পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, আই টি সেক্টরে ব্যবসা আছে এই আই পি গুপ্তার গত বছরে পাটনাতে র্যালি মানুষের চোখ কেড়েছিল। ৪) অবশ্যই এখনকার রাজ্যের সরকার বিরোধী কিছু ভোট তো প্রধানবিরোধীদের ঝোলাতে পড়বেই, তারসঙ্গে প্রত্যেক মহিলাকে বছরে ৬০ হাজার করে টাকা দেবার মহাগটবন্ধনের প্রতিশ্রুতিও কিন্তু কিছুটা হলেও কাজ করবে। আর এই মহাগটবন্ধনের বোঝা টা কী? ১) বিরাট বোঝা হল সেই লালুর জঙ্গলরাজের ইস্যু। আসলে ক্ষমতায় এসেই উচ্চবর্ণ তো বটেই, এমনকি নিম্ন বর্ণের ইবিসিদের ওপরেও ছড়ি ঘুরিয়েছিল যাদবরা, সেই দাগ, সেই স্মৃতি এখনও থেকে গেছে। ২) ঘরের ভেতরের লড়াই, তেজ প্রতাপ যাদব সাহায্য পাচ্ছেন বিজেপির কাছ থেকে, বেশ কিছু জায়গাতে প্রার্থী দিয়েছেন, কত ভোট কাটবেন কারোর জানা নেই। ৩) আসাউদ্দিন ওয়েইসির এম আই এম বেশ কিছু জায়গাতে প্রার্থী দিয়েছে, এমনিতে মুসলমান সংখ্যালঘু মানুষজন বিজেপির বিরুদ্ধে জিতবে, জিততে পারে তেমন জোটকেই ভোট দেবে তবুও সীমাঞ্চলে সংখ্যালঘু এলাকাগুলোতে কিছু ভোট তারা কাটবে। হ্যাঁ দুই জোটেরই ভোট জোড়া আর কাটাকাটির বেশ কিছু হিসেব আছে, যার তল পাওয়া অসম্ভব।
Информация по комментариям в разработке