আমরা একবিংশ শতাব্দীর এমন এক ক্রান্তিকালে বসবাস করছি, যেখানে তথ্য ও প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ মানুষের চিন্তা, দর্শন এবং জীবনযাপনের পদ্ধতিকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে। এই আধুনিকতার প্রবল স্রোতে আমাদের তরুণ সমাজ, বিশেষত যারা अकादमिक বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সাথে জড়িত, তাদের মনে ইসলামি জীবনবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা প্রশ্ন, সংশয় এবং জিজ্ঞাসা। ইসলামি শরিয়তের প্রতিটি বিধান, যেমন—পর্দা, সুদ, জিহাদ, পোশাক, পরিবার ব্যবস্থা, দণ্ডবিধি ইত্যাদি কেন আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক? এগুলোর পেছনে অন্তর্নিহিত যুক্তি, বিজ্ঞান ও দর্শন কী? নিছক বিশ্বাস বা ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তির বাইরে এগুলোর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি আছে কি?
এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর যখন সঠিকভাবে ও যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করা হয় না, তখন এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যস্থান পূরণ করতেই পশ্চিমা বস্তুবাদী দর্শন ও নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারা তরুণদের মনোজগতে স্থান করে নেয়। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে, মুসলিম উম্মাহর দরদী রাহবার, হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর কালজয়ী গ্রন্থ "ইসলামি বিধানের বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্থাপনা" এক আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। এটি শুধু একটি বই নয়, বরং এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, যা আধুনিক মননকে ইসলামি জ্ঞানের গভীরতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.): উম্মাহর আত্মার চিকিৎসক
মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম, মুজাদ্দিদ এবং সমাজ সংস্কারক। তাকে 'হাকীমুল উম্মত' বা 'উম্মাহর আত্মার চিকিৎসক' উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে, কারণ তিনি মুসলিম সমাজের আধ্যাত্মিক, সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক রোগগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করে তার কার্যকর সমাধান দিয়েছেন। তাঁর লেখনী ও কর্মের পরিধি এতটাই বিস্তৃত যে, তা আজও গবেষক ও সাধারণ মুসলমানদের পথ প্রদর্শন করে। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন তাসাউফের উঁচু স্তরের একজন শায়খ, তেমনই অন্যদিকে ছিলেন শরিয়তের সূক্ষ্ম বিষয়াবলীর একজন গভীর জ্ঞানী। তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি যুগের চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে পারতেন এবং ইসলামের শ্বাশত জ্ঞানকে সেই যুগের ভাষায় মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। "ইসলামি বিধানের বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্থাপনা" গ্রন্থটি তাঁর এই দূরদর্শী চিন্তারই এক উজ্জ্বল ফসল।
গ্রন্থ পরিচিতি: কেন এই বই?
মূল উর্দুতে এই গ্রন্থটির নাম "আহকামে ইসলাম আকল কি নজর মে"। এর ইংরেজি অনুবাদ "Islam and Rationalism" নামেও পরিচিত। গ্রন্থটি রচনার প্রেক্ষাপট ছিল এমন এক সময়, যখন মুসলিম সমাজে পশ্চিমা শিক্ষা ও দর্শনের প্রভাবে ইসলামি বিধান নিয়ে এক ধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হচ্ছিল। অনেক শিক্ষিত মুসলিম যুবক ইসলামের বিধানগুলোকে সেকেলে, অযৌক্তিক এবং আধুনিক যুগের সাথে বেমানান বলে মনে করতে শুরু করেছিল।
হযরত থানভী (রহ.) এই বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট মোকাবেলার জন্য কলম ধরেন। তিনি এই গ্রন্থে ইসলামের বিভিন্ন বিধানের পেছনের হিকমত, যৌক্তিকতা এবং দার্শনিক ভিত্তিগুলোকে অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, ইসলামি বিধানগুলো কোনো অর্থহীন প্রথা বা অন্ধ বিশ্বাসের সমষ্টি নয়, বরং এর প্রতিটি বিধানের পেছনে রয়েছে মানবজাতির জন্য কল্যাণকামিতা, গভীর যুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। এই বইটি মূলত সেইসব जिज्ञासु মনের জন্য লেখা, যারা الإسلامকে শুধু উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটি ধর্ম হিসেবে নয়, বরং একটি জীবন দর্শন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণাদির ওপর প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে চায়।
অনুবাদকের ভূমিকা: মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার
এই অসাধারণ গ্রন্থটিকে বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মহৎ কাজটি করেছেন মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার। তাঁর অনুবাদ অত্যন্ত প্রাঞ্জল, সাবলীল এবং মূল লেখকের ভাবকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছে। একটি জটিল দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনাকে বাংলা ভাষায় এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ, এবং অনুবাদক সেটিতে সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েছেন। তাঁর শব্দচয়ন এবং বাক্য গঠন মূলানুগ হওয়ায় পাঠক সহজেই হযরত থানভী (রহ.)-এর চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে পারেন।
এই বইটি কাদের জন্য?
এই বইটি নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণীর পাঠকের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর আবেদন ব্যাপক।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী: যারা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন এবং যাদের মনে ইসলাম নিয়ে নানা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, তাদের জন্য এই বই এক অমূল্য পাথেয়।
বুদ্ধিজীবী ও গবেষক: যারা ইসলামকে একটি अकादमिक দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে চান এবং এর দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী, তাদের জন্য এটি একটি অপরিহার্য গ্রন্থ।
দায়ী ও আলেম: যারা ইসলামের দাওয়াত মানুষের কাছে, বিশেষ করে শিক্ষিত শ্রেণীর কাছে তুলে ধরতে চান, তাদের জন্য এই বইটি একটি চমৎকার রিসোর্স। এটি তাদের শেখাবে কীভাবে সমসাময়িক ভাষায় ও যুক্তির মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য উপস্থাপন করতে হয়।
সাধারণ পাঠক: প্রত্যেক মুসলিম, যিনি তার ধর্মকে জেনে-বুঝে পালন করতে চান এবং নিজের ঈমানকে সন্দেহের দোলাচল থেকে রক্ষা করে বুদ্ধিবৃত্তিক দৃঢ়তার ওপর প্রতিষ্ঠা করতে চান, তার জন্য এই বই পড়া আবশ্যক।
সমাপনী: বিশ্বাসের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি খোঁজার এক অনবদ্য যাত্রা
"ইসলামি বিধানের বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্থাপনা" শুধু কিছু প্রশ্নের উত্তর নয়, এটি একটি চিন্তার পদ্ধতি। এই বই আমাদের শেখায় কীভাবে ইসলামকে একটি সামগ্রিক ও যৌক্তিক জীবনব্যবস্থা হিসেবে দেখতে হয়। এটি আমাদের হীনম্মন্যতার খোলস থেকে বের করে আত্মবিশ্বাসের সাথে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করতে শেখায়।
তবে এই বইটি আপনার জন্যই। এটি আপনার চিন্তার জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং আপনার ঈমানকে আরও মজবুত করবে, ইনশাআল্লাহ। বইটি সংগ্রহ করুন, পড়ুন এবং আপনার জিজ্ঞাসু বন্ধুদেরও পড়তে উৎসাহিত করুন। ইসলামকে জানার এই বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রায় আপনাকে স্বাগতম।
Информация по комментариям в разработке