গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে, কিভাবে বুঝবেন?
গর্ভবতী অবস্থায় মা-বাবাদের মনে অনেক কৌতূহল কাজ করে—গর্ভে যে সন্তান আছে, সে কি ছেলে না মেয়ে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে অনেকেই নানা উপায় খোঁজেন। কেউ বিজ্ঞানের পথে হাঁটেন, কেউ শোনেন দাদি-নানির বলা প্রচলিত লক্ষণ বা ধারণা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কীভাবে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারিত হয় এবং কোন পদ্ধতিগুলো নির্ভরযোগ্য, তা জানা খুব জরুরি।
একটি শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ হয় পুরুষের শুক্রাণুর মাধ্যমে। ডিম্বাণু সবসময় একটি X ক্রোমোজোম বহন করে, আর শুক্রাণু হয় X নয়তো Y ক্রোমোজোম বহন করে। যদি ডিম্বাণুতে X ক্রোমোজোমযুক্ত শুক্রাণু ঢুকে পড়ে, তাহলে মেয়ে (XX) সন্তান জন্ম নেয়। আর যদি Y ক্রোমোজোমযুক্ত শুক্রাণু ঢুকে পড়ে, তাহলে ছেলেসন্তান (XY) জন্ম নেয়। অর্থাৎ, শিশুর লিঙ্গ পুরোপুরি নির্ভর করে পুরুষের শুক্রাণুর উপর এবং এটি স্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে শিশুর লিঙ্গ জানার সবচেয়ে প্রচলিত ও সহজ উপায় হলো আল্ট্রাসাউন্ড। গর্ভাবস্থার ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে সাধারণত anomaly scan বা mid-pregnancy ultrasound করা হয়, যেখানে শিশুর যৌনাঙ্গ স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো অনেক দেশে গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ করা আইনত নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞা মূলত লিঙ্গ বৈষম্য এবং ভ্রূণহত্যা রোধে গৃহীত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ফলে চিকিৎসকরা ইচ্ছাকৃতভাবে ছেলে না মেয়ে তা জানান না।
তবে বহু পুরনো কাল থেকে কিছু লক্ষণ বা চিহ্ন নিয়ে নানা রকম কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। যদিও এগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তবুও অনেকেই এগুলো বিশ্বাস করেন। যেমন বলা হয়, মায়ের সৌন্দর্য কমে গেলে মেয়ে সন্তান, আর উজ্জ্বল ত্বক থাকলে ছেলে সন্তান হতে পারে। সকালের বমিভাব বেশি হলে মেয়ে, আর কম হলে ছেলে হতে পারে। শিশুর হার্টবিট যদি ১৪০ এর বেশি হয় তাহলে মেয়ে, কম হলে ছেলে—এই ধরণের অনেক বিশ্বাস রয়েছে। আবার বলা হয়, যদি মা মিষ্টি খাবারের প্রতি বেশি আগ্রহী হন তাহলে মেয়ে, আর নোনতা বা ঝাল খাবারের প্রতি ঝোঁক থাকলে ছেলে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মায়ের পেট চওড়া বা উপরের দিকে থাকলে মেয়ে, নিচের দিকে ঝুলে থাকলে ছেলে—এমন আরও অনেক চেকলিস্ট রয়েছে যা শুধু বিশ্বাসের জায়গায় সীমাবদ্ধ।
তবে এসব ধারণা শুধুই লোকমুখে প্রচলিত। এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অনেক সময় এগুলোর কারণে মায়েরা মানসিক বিভ্রান্তিতে ভোগেন। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো, এসব লক্ষণের ওপর নির্ভর না করে প্রকৃত তথ্যের জন্য সঠিক চিকিৎসা ও পরীক্ষার দিকেই মনোযোগী হওয়া।
যেসব দেশে আইনি বাধা নেই, সেখানে আধুনিক কিছু টেস্টের মাধ্যমে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয়। যেমন, NIPT (Non-Invasive Prenatal Testing) যা মায়ের রক্তের মাধ্যমে শিশুর DNA বিশ্লেষণ করে। এটি ৯ সপ্তাহের পর থেকেই করা যায় এবং প্রায় ৯৯ শতাংশ নির্ভুল ফলাফল দেয়। এছাড়াও Chorionic Villus Sampling (CVS) এবং Amniocentesis নামক পরীক্ষাগুলো করা হয়, কিন্তু সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাধারণত জেনেটিক রোগ চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে এই ধরণের পরীক্ষা শুধুমাত্র চিকিৎসাগত কারণে করা হয়ে থাকে, শিশুর লিঙ্গ জানার জন্য নয়।
বাংলাদেশে গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ জানার বিষয়ে কঠোর আইন রয়েছে। এই বিষয়ে “Pre-Conception and Pre-Natal Diagnostic Techniques (PCPNDT) Act” অনুসরণ করা হয়। কেউ যদি গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে। এই আইনের উদ্দেশ্য হলো ভ্রূণ হত্যার প্রবণতা রোধ এবং সমাজে ছেলে-মেয়ে উভয়ের প্রতি সমান মূল্যবোধ গড়ে তোলা।
চিকিৎসকদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, একজন সুস্থ শিশু পাওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছেলে বা মেয়ে, যেটাই হোক না কেন, সন্তানের সুস্থতা ও নিরাপদ জন্মই সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। লিঙ্গ জানার অযথা কৌতূহল অনেক সময় মায়ের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ফলে সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থাতেই মা উদ্বেগ ও হতাশায় ভুগতে পারেন, যা গর্ভাবস্থার জন্য ক্ষতিকর।
অনেক সময় দেখা যায় পরিবার থেকে ছেলে সন্তানের জন্য চাপ তৈরি করা হয়। আবার কেউ কেউ মেয়ে সন্তান চায় বিশেষ কারণে। এই ধরণের চাহিদা বা প্রত্যাশা মা'র উপর মানসিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক সময় মা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে পছন্দমতো লিঙ্গ না পান, তাহলে হতাশা বা বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে, যাকে বলা হয় gender disappointment। এই অনুভূতি খুবই বাস্তব এবং এর প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার।
মা-বাবাদের জন্য পরামর্শ হলো, কৃতজ্ঞতা চর্চা করুন, সুস্থ গর্ভাবস্থার দিকেই মনোযোগ দিন এবং সমাজের ক্ষতিকর প্রত্যাশা থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। প্রতিটি সন্তানই ঈশ্বরের আশীর্বাদ—সে ছেলে হোক বা মেয়ে।
এছাড়াও কিছু জনপ্রিয় লক্ষণ রয়েছে যেগুলো অনেকেই চেকলিস্ট আকারে দেখে থাকেন। যেমন:
ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে হৃদস্পন্দন ১৪০ এর নিচে থাকে, নোনতা বা ঝাল খাবার খেতে ইচ্ছা করে, ত্বক পরিষ্কার থাকে, মা শান্ত মেজাজে থাকেন, পেট নিচের দিকে ঝুলে থাকে, শিশুর নড়াচড়া দ্রুত ও শক্তিশালী হয় এবং পেটের দাগ বা লিনিয়া নিগ্রা নাভির ওপরে চলে যায়। অন্যদিকে মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে হার্টবিট ১৪০ এর বেশি হয়, মিষ্টি খেতে ইচ্ছা করে, ব্রণ বা ত্বকের সমস্যা দেখা যায়, মা একটু আবেগপ্রবণ হন, পেট গোল এবং চওড়া হয়ে থাকে, শিশুর নড়াচড়া নরম ও হালকা হয় এবং লিনিয়া নিগ্রা নাভিতেই থেমে যায়।
যদিও এই লক্ষণগুলো বিশ্বাসের জায়গা থেকে তৈরি, তবুও এগুলো অনেকের কাছে আগ্রহের বিষয়। তবে মনে রাখতে হবে, এগুলো নিশ্চিত কোনো উপায় নয়। শুধু একটি মজার দিক বা মিথ বলেই এগুলোকে দেখা উচিত।
সবশেষে, গর্ভাবস্থার পুরোটা সময় মায়ের সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি ও শিশুর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করাটাই সবচেয়ে জরুরি। লিঙ্গ যা-ই হোক না কেন, একটি সুস্থ এবং ভালো ভবিষ্যৎই প্রত্যেক সন্তানের প্রাপ্য।
#pregnancy #babyboy #boy #babygirl #girl #baby
Информация по комментариям в разработке