Скачать или смотреть চণ্ডীমঙ্গল কাব্য: রামায়ণের গল্প, চরিত্র ও উপযোজন এর দ্বারা দেবী চণ্ডীর বৈধতা জ্ঞাপন

চণ্ডীমঙ্গল-কাব্য: রামায়ণের গল্প, চরিত্র, ও উপযোজন এর দ্বারা দেবী চণ্ডীর বৈধতা জ্ঞাপন

দীপশিখা আচার্য্য
সহকারী অধ্যাপক
ইতিহাস বিভাগ
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়

চণ্ডীমঙ্গল-কাব্য বাংলা মঙ্গলকাব্য সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এটি ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল। এই ধারার কবিতাগুলোতে মূলত স্থানীয় দেব-দেবীদের, এবং এখানে দেবী চণ্ডীর বন্দনা করা হয়েছে। এসব কাব্য বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের পরিবর্তন, ধর্মীয় সমঝোতা এবং সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ছবি তুলে ধরে। তখন বাংলায় মুসলিম শাসন চলছিল এবং ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের সঙ্গে তার মিশ্রণ ঘটছিল।
চণ্ডী দেবীর উৎস পাওয়া যায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মগ্রন্থ যেমন মার্কণ্ডেয় পুরাণ এর দেবীমাহাত্ম্য-এর অংশে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেবীর রূপ ও উপাসনার ধরনও বদলেছে। বাংলায় চণ্ডীর পূজায় স্থানীয় লোকবিশ্বাস ও সর্বভারতীয় দেবী-ধারণা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এ সময়ে আঞ্চলিক ভাষায় ভক্তিমূলক সাহিত্যও জনপ্রিয় হয়।
এই প্রবন্ধে মূলত মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসকে চণ্ডীমঙ্গল-কাব্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে। বিশেষ করে কাব্যের বিভিন্ন সংস্করণ কীভাবে সেই সম���়কার সমাজ ও রাজনীতির রূপ তুলে ধরেছে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মূল প্রশ্ন হলো, চণ্ডীমঙ্গল-কাব্য কীভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা পেল? প্রবন্ধটি বিশেষভাবে রামায়ণ-এর দিকে নজর দিয়েছে। কারণ, রামায়ণ দেবী চণ্ডীকে জনপ্রিয় করে তুলতে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। রামায়ণের গুরুত্ব শুধু তার কাহিনীতে নয়; এর সহজ ভাষা ও অনুবাদ সাহিত্য, বাংলার মানুষকে এটি পড়তে ও বুঝতে সাহায্য করেছিল।
ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে বহু কবি চণ্ডীমঙ্গল-কাব্য রচনা করেছেন। তাঁদের কবিতায় সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির ছাপ স্পষ্ট। অনেক কবি তাঁদের কবিতার ভূমিকায় নিজের জীবন, পৃষ্ঠপোষকতা ও সেই সময়ের ইতিহাস, যেমন সুলতানি ও মুঘল শাসনের প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন।
চণ্ডীমঙ্গল-কাব্যের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো রামায়ণের কাহিনি, চরিত্র ও ঘটনা নিজেদের কবিতায় ব্যবহার করা এবং রামায়ণের উপযোজন এর সাহায্যে দেবী চণ্ডীর গ্রহণশীলতা বাড়ানো। কবিরা রামায়ণের জনপ্রিয়তা ও ধর্মীয় মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে চণ্ডীর পূজার বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তাঁরা চণ্ডীর কাহিনিকে রামায়ণের ঘটনাগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দেখিয়েছেন, যেমন শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব, আদর্শ রাজা কেমন হওয়া উচিত বা সমাজের নিয়ম-কানুন কেমন। গবেষণার জন্য যখন এই কাব্যগুলোকে কাঠামোগতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তখন দেখা যায় একধরনের পুনরাবৃত্তি: চণ্ডী ও তাঁর ভক্তদের নায়ক হিসেবে দেখানো হয়, আর তাঁদের শত্রুদের অসুর বা দুষ্ট শক্তি হিসেবে। এতে চণ্ডীর মর্যাদা বেড়েছে এবং তাঁকে নৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
পুরাণ ও বাংলা রামায়ণের কিছু কাহিনি, বিশেষত রামের অকালবোধন বা অকাল পূজা, চণ্ডী, দুর্গা বা অম্বিকার পূজার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে, যা বাল্মিকীর রামায়ণে ছিলনা। এইভাবে চণ্ডীর পূজা বাংলার ধর্মীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং আজ যে আমরা বার্ষিক শরৎকালীন দুর্গোৎসব-এ্র প্রতি বছর মেতে উঠি তার পিছনেও রয়েছে এই কাব্যের অমূল্য অবদান।


ডঃ দীপশিখা আচার্য্য এঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি


প্রথিতযশা গবেষক ডঃ দীপশিখা আচার্য্য (এম.এ., পিএইচ.ডি., কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপিকা হিসেবে কর্মরত। তিনি পূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এবং ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অতিথি প্রভাষক হিসেবে অধ্যাপনা করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নয়াদিল্লির ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ (ICHR)-এর পোস্ট-ডক্টোরাল ফেলো হিসাবে ভূমিকা পালন করেন।

তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব। গবেষণায় তিনি বিশেষভাবে লোহার উৎপাদন ও ব্যবহার, প্রায়-ইতিহাস এবং মধ্যযুগের প্রারম্ভিক প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। পাশাপাশি পরিবেশের ইতিহাস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস, এবং সামাজিক ইতিহাস তাঁর বিশেষ আগ্রহের ক্ষেত্র।

তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের স্বীকৃত পিয়ার-রিভিউড জার্নালে বিভিন্ন গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ ও উল্লেখযোগ্য গবেষণা সংকলনসমূহ আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে। তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ Iron in India: History and Historiography, Primus Books, New Delhi থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও, তাঁর সম্পাদিত (প্রথম সম্পাদক হিসেবে) আসন্ন গ্রন্থ Locating the 'Local' in South Asia: Critical Themes in the History of Northern Bengal Routledge (London and NewYork) থেকে শীঘ্রই প্রকাশিতব্য।