খাবার টেবিলে কিংবা ঘরোয়া যেকোনো আড্ডায় বাবা প্রায়ই বলতেন, আমি মনে হয় আর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাব না। একজীবনে এত এত ছবিতে অভিনয় করলাম, একটা ছবিও কি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার মতো না, মা! কী করলাম তাহলে! ভেবে কষ্ট পাই রে, মা।’
কথাগুলো বলছিলেন দেশের গুণী কৌতুক অভিনয়শিল্পী টেলি সামাদের ছোট মেয়ে সায়মা সামাদ। সন্ধ্যায় বাবাকে নিয়ে বলতে গিয়ে বাবার এসব কথা মনে করে বারবার কেঁদে উঠছিলেন তিনি।
RFL Gas Stoveএকজীবনে টেলি সামাদ ছয় শর মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তাঁর অধরাই রয়ে গেল। এ নিয়ে টেলি সামাদ নিজেও আক্ষেপ করেছেন বহুবার। মৃত্যুর আগে একাধিকবার তিনি বলেছিলেন, ‘চার দশক ধরে চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। এতগুলো বছরে আমি পাঁচ শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। প্রত্যেকটি ছবিতে আমার অভিনয় প্রশংসিত ছিল। কিন্তু শেষ জীবনে এসে আমার একটাই আক্ষেপ, আমি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলাম না। আমার পুরো চলচ্চিত্রজীবন আমি শুধু অভিনয়ের বলয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখিনি। ছবি প্রযোজনা করেছি, ছবিতে গানও গেয়েছি। এসবের প্রাপ্তি হিসেবে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। সেসব পুরস্কারে আমার ঘর ভর্তি হয়ে আছে। শুধু নেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার!’
বাংলা চলচ্চিত্রের দাপুটে কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদ। সত্তরের দশক থেকে নিয়মিত কাজ করেছেন তিনি। মাঝে বিরতি নিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে আবার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। বর্ণাঢ্য চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে অসংখ্য জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। পেয়েছেন এ দেশের মানুষের মনপ্রাণ উজাড় করা ভালোবাসা।
‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘সাম্পানওয়ালা’, ‘লাইলি মজনু’, ‘বধূ বিদায়’, ‘ভাত দে’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘পায়ে চলার পথ’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘মধুমিতা’, ‘সানাই’, ‘পাগলা রাজা’, ‘নয়নমণি’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ঘর সংসার’, ‘বৌরানী’, ‘মাটির ঘর’, ‘নাগরদোলা’, ‘কথা দিলাম’, ‘শেষ উত্তর’, ‘এতিম’, ‘দিলদার আলী’, ‘মনা পাগলা’, ‘সোহাগ’, ‘রূপবান, ‘মতিমহল’, ‘চাষীর মেয়ে’, ‘ওয়াদা’, ‘আমার স্বপ্ন আমার সংসার’, ‘রিকশাওয়ালার ছেলে’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’, ‘কাজের মানুষ’, ‘মায়ের হাতে বেহেস্তের চাবি’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’সহ অসংখ্য ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শকমনে দাগ কেটে গেছে। অথচ চলচ্চিত্রজীবনে জাতীয় পর্যায়ের এই অর্জন নিয়ে একটা চাপা কষ্ট আর দুঃখবোধ বাবাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বলেই মনে করছেন মেয়ে সায়মা। তিনি বলেন, ‘আমার তো মনে হয়, বাবার অভিনয় পছন্দ করে না, এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের এই দেশে খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। বাবা তো অসাধারণ অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। ছবি নিয়েই ছিল বাবার যত ধ্যানজ্ঞান। এত এত ছবিতে অভিনয়, এত এত বছর মানুষের মন জয় করেছেন— তাঁর কি জীবনে একবার হলেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার মতো অভিনয় হয়নি! থাক, সেসব এখন আর বলে কী লাভ। যিনি চেয়েছিলেন, তিনিই তো আজ আমাদের সবাইকে ছেড়ে গেলেন। বুকে একটা কষ্ট নিয়েই বাবা চলে গেলেন।’
২০১৬ সালে চলচ্চিত্র পুরস্কারের একটি অনুষ্ঠানে নিজের আক্ষেপের কথা জানিয়ে টেলি সামাদ বলেছিলেন, ‘এটা যেহেতু জাতীয় চলচ্চিত্র পর্যায়ের পুরস্কার, সেহেতু আমার মনে হয় এটা অর্জন করতে হলে জাতে ওঠা লাগে। কবে যে জাতে উঠব, আর কবে এই পুরস্কারটা পাব, তা আল্লাহ মালুম!’
পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে হৃদ্রোগসহ নানা জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন এই কৌতুক অভিনেতা। এই সময়টায় তাঁকে প্রায়ই হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে আবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন অবস্থা আরও খারাপ হলে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় এই কৌতুক অভিনেতাকে লাইফ সাপোর্টে রাখার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। শনিবার বেলা দেড়টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলেসহ অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে গেছেন। দুই মেয়ে ঢাকায় ও ছেলে সুমন সামাদ যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
প্রথম আলোকে টেলি সামাদের বড় মেয়ে সোহেলা সামাদ জানান, গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের নয়াগাঁওয়ে বাবাকে তাঁর বাবা-মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। রোববার বাদ জোহর সমাহিত করার আগে শেষবারের মতো বাবাকে তাঁর কর্মস্থল এফডিসিতে নেওয়া হবে। রোববার বেলা ১১টা থেকে মরদেহে চলচ্চিত্রের বন্ধু, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারবেন। এখানে জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে।
এদিকে শনিবার বিকেলে হাসপাতাল থেকে টেলি সামাদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ধানমন্ডির তাকওয়া মসজিদে। সেখানে বাদ মাগরিব প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় তাঁর বাড়ির পাশের মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা হয়।
গত শতকের সত্তরের দশক থেকে টেলি সামাদকে পর্দায় দেখেছেন দর্শকেরা। এযাবৎ অসংখ্য চলচ্চিত্র ও নাটকে নানা ধরনের চরিত্রে তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় দর্শকের মনে দাগ কেটে আছে দারুণভাবে। নিজের অভিনয়শৈলী দিয়ে দর্শকদের বিনোদন ও হাসিতে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখতেন টেলি সামাদ। একসময় কৌতুক অভিনেতার প্রসঙ্গ উঠলেই চলে আসত তাঁর নাম। সমানতালে অভিনয় করেছেন সিনেমায় ও টেলিভিশনে। পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়তা।
১৯৬৬ সালে পরিচালক নজরুল ইসলামের ‘কার বউ’ চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। চার দশকে প্রায় ৬০০ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। টেলি সামাদ শেষ কাজ করেছেন ২০১৫ সালে অনিমেষ আইচের ‘জিরো ডিগ্রি’ ছবিতে। তবে তিনি দর্শকদের কাছে ‘পায়ে চলার পথ’ ছবির মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পান। অভিনয়ের বাইরে অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্রে তিনি গান গেয়েছেন।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা টেলি সামাদ তাঁর বড় ভাই চারুশিল্পী আবদুল হাইকে অনুসরণ করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। সিনেমায় প্রবেশের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের চিত্রগ্রাহক মোস্তফা মামুন তাঁর ডাকনাম দিয়েছিলেন টেলি সামাদ। তারপর থেকে তিনি এ নামেই পরিচিত হন।
Информация по комментариям в разработке