ভারতের প্রাচীন মুনি ঋষিগণ উপনিষদের মাধ্যমে বলছেন শব্দব্রহ্ম-সাধনা বা ওঙ্কারের সাধনা সর্ব্বোৎকৃষ্ট। এই শব্দ ব্রহ্মের সাধনা কেন সর্ব্বশ্রেষ্ট, আর কিভাবেই বা আমরা তা করতে পারি, সে সম্পর্কে আজ থেকে আমরা শুনবো।
প্রথমেই বলি, আমাদের শরীর, এমনকি এই যে জগৎ তা পঞ্চতত্ত্বের সমাহার। আর তা হচ্ছে ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম। আর এগুলোর নিজস্ব গুন্ হচ্ছে - গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ, শব্দ। অর্থাৎ আকাশের গুন্ হচ্ছে, শব্দ, বাতাসের গুন্ হচ্ছে স্পর্শ, অগ্নি বা তেজের গুন্ হচ্ছে রূপ, জলের গুন্ হচ্ছে রস, আর ক্ষিতির গুন্ হচ্ছে গন্ধ। এই কথাগুলোর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। এসব আমরা সবাই জানি।
কিন্তু আমাদের যে বাহ্যিক সাধনক্রিয়া তাও এই তত্ত্বানুসারী। অর্থাৎ পাঁচ প্রকার। যেমন - ১. আমরা মাটি বা পাথরের পুজো করে থাকি। যা আসলে পৃথ্বীতত্ত্বের । ২. আমরা যে গঙ্গার, যমুনার, সরস্বতী, সিন্ধু,কাবেরী, নর্মদার, ইত্যাদির পূজা করি, তা আসলে অপ তত্ত্বের সাধনা। ৩. আমরা যে চন্দ্র সূর্য তারকা রাজির পুজো করি, তা আসলে এই তেজ তত্ত্বের সাধনা। ৪. আমরা যে প্রাণায়াম ইত্যাদি শ্বাসে-প্রশ্বাসের সাধনা করি তা আসলে এই মরুৎ তত্ত্বের সাধনা। সবশেষে আমরা শব্দের বা মন্ত্রসাধনা করি ইত্যাদির সাধনা করি তা আসলে এই ব্যোম তত্ত্বের সাধনা। আর এগুলো করি তার কারন হচ্ছে এই তত্ত্বের মধ্যে যে গুন্ আছে, সেই গুনের বিকাশ ঘটাতে চাই। হিন্দুসাধন পদ্ধতির এ এক অদ্ভুত গুড় রহস্যঃ। পুতুল পূজা, মুর্তিপূজা, জপ তপ এর কোনোটাই ছেলেমানুষী নয়, বা লোভী পন্ডিতের কূটকৌশল নয়। এ সব সাধনার মধ্যেই নিহিত আছে, গভীর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। যা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের বাইরে।
এই শরীর, একমাত্র শরীরই আমাদের সাধন ক্ষেত্র। মনুষ্য শরীর ভিন্ন কোনো সাধনা সম্ভব নয়। সমস্ত জীবকুলের শরীরের মধ্যে তিনি আছেন, কিন্তু মনুষ্য শরীরের মধ্যেই তিনি অধিক প্রকট। তাই মহাত্মাগন বলে গেছেন, শরীর দুই প্রকার, এক - যে শরীরে কর্ম্ম করা যায়, আবার কর্ম্মফল ভোগও করা যায়। অর্থাৎ ভোগ ও যোগ দুইই করা যায়। আর তা হচ্ছে একমাত্র এই স্থুল মনুষ্য শরীর। এই স্থুল মনুষ্য শরীর যোগের দ্বারা পক্ক হলে, ঈশ্বর অনুভূতি লাভ করা সম্ভব। আর এক প্রকার শরীর আছে, যে শরীরে কেবলমাত্র ভোগ সম্পাদিত হতে পারে। এদের কোনো কর্ম্মফল সঞ্চিত হতে পারে না। যেমন ইতর জীব, বা দেবতাদের শরীর। তো এই মনুষ্য শরীরের মধ্যেই আছে সেই পরমপুরুষ, আত্মা, ব্রহ্ম। এই শরীর-বিনা সাধন যেমন সম্ভব নয়। এই শরীর ছেড়ে দিয়ে, আমরা কখনো ঈশ্বরের খোঁজ পাবো না।
এইবার আমরা দেখে নেই, আমাদের এই দুর্লভ শরীরের কোথায় এই পাঁচ তত্ত্বের অবস্থান। যোগীপুরুগ্ণ বলে থাকেন, "ত্রৈলোক্যে যানি ভূতানি তানি সর্ব্বাণি দেহতঃ" । এই ত্রিলোকে অর্থাৎ ভূলোক, অন্তরিক্ষলোক, এবং দ্যুলোক - এই তিনটি লোকে যাকিছু আছে, আমাদের দেহভান্ডারেও তার সমস্তই আছে। আমরা জানি, পঞ্চভূতের তৈরী এই শরীর। আবার প্রকৃতিতে তিনটি গুনের সমাহার। সত্ত্ব, রজো, ও তম।
১. এই পঞ্চতত্ত্বের আদি তত্ত্ব আকাশ তত্ত্ব - যা আসলে সেই আধ্যাত্মিক সূক্ষ্ম দেশ কালের সমন্বয়। এই আকাশভূত সত্ত্বগুণের মাধ্যমে, অনন্ত ব্রহ্মান্ডকে ধারণ করে আছে। এই আকাশের বিশেষ গুন্ হচ্ছে শব্দ। আমাদের এই যে স্থূল দেহ এখানে শব্দকে গ্রহণ করবার ক্ষমতা রাখে কর্ণেন্দ্রিয়। এই শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে কেন্দ্র করেই আকাশভূত আমাদের শরীরে কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে থাকে। আমাদের শরীরে যত ছিদ্র আছে, অর্থাৎ শিরা-উপশিরা-ধমনী, লোমকূপ, এমনকি আমাদের স্নায়ু ও মজ্জার ভিতরে যে ফাঁকা জায়গা বা গর্ত আছে তা এই আকাশ তত্ত্ব থেকেই উদ্ভূত। মহাত্মাগণ বলছেন, আকাশভূত সত্ত্বগুণের অধিকারী। তাই সত্ত্বগুণের অধিকারী পুরুষ-এর মধ্যে আকাশতত্ত্বের আধিপত্য।
২. এই সত্ত্বগুণ ও রজোগুণের মিশ্রনে বায়ুভূত প্রকাশিত হয় । বায়ুর নিজস্ব গুন হচ্ছে স্পর্শ আর উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে শব্দগুন। এই বায়ু আমাদের শরীরের ত্বকের মাধ্যমে স্পর্শের অনুভূতি জাগায়। এই বায়ুই আমাদের দেহের প্রাণশক্তি। প্রাণের বীজ নিহিত আছে এই বায়ুর মধ্যে। তাই বলা হয় প্রাণকোষের নির্মাতা হচ্ছে বায়ু। বায়ুভূতের আধিক্য যার মধ্যে বেশী তিনি প্রাণবন্ত, উদ্দমী পুরুষ।
৩. অগ্নিতত্বে আছে তেজভূত - যা আসলে রজোশক্তির প্রকাশ। এই তেজভূতের নিজস্ব গুন্ হচ্ছে রূপ, আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া শব্দ ও স্পর্শ। তাই অগ্নিতত্ত্বে আছে তিনটি গুনের সমাহার শব্দ-স্পর্শ ও রূপ। সৃষ্টির প্রথম রূপ হচ্ছে এই অগ্নি। এই পৃথিবীও প্রথমে অগ্নির গোলক হিসেবে দৃশ্যমান হয়েছিল। আমাদের স্থূল দেহের যে দৃষ্টিশক্তি বা রূপের ভোগ, তা এই তেজোশক্তির প্রভাবেই ঘটে থাকে। এই অগ্নি আমাদের দেহের তেজশক্তি বা বল। এই অগ্নিই আমাদের দেহে জঠরাগ্নি রূপে খাদ্যসকল জীর্ন ক'রে, খাদ্যের নির্যাস বের করে থাকে। এই তেজশক্তি আমাদের দেহের উত্তাপ রক্ষা করে থাকে, দেহের পোষন এমনকি দেহের যে বর্দ্ধন ক্রিয়া, তাও এই তেজশক্তির দ্বারাই সম্পন্ন হয়ে থাকে। এই অগ্নিতত্ত্বের অধিকারী পুরুষ তেজস্বী, দীপ্তিমান।
৪. অপতত্ত্ব রজ ও তম গুনের মিশ্রণ। এই অপ বা জলতত্ত্বের প্রধান গুন্ হচ্ছে রস। আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া শব্দ, স্পর্শ, আর রূপ। এই অপতত্ত্বই আমাদের রসনা শক্তি বা রস আস্বাদন শক্তিকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়ে থাকে। শরীরের যাবতীয় রস, রক্ত, শুক্ৰ প্রভৃতি এই জলভূত থেকে উৎপন্ন। অপতত্বের আধিক্য হেতু, মানুষ ভোজনরসিক হয়ে থাকেন। এদের মধ্যে আলস্য ও কর্ম্মে উদ্দম উভয়ই দেখা যায়।
৫. পৃথ্বী বা ক্ষিতিতত্ত্ব তমগুনের প্রকাশ। ক্ষিতিতত্ত্বের বিশেষ গুন্ হচ্ছে গন্ধ। আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস। আমাদের ঘ্রাণেন্দ্রিকে কেন্দ্র করে এই পৃত্থীতত্ত্বের প্রকাশ ঘটে থাকে। আমাদের অস্থি, চর্ম্ম, মাংস, মজ্জা অর্থাৎ শরীরের সমস্ত স্থূল পদার্থ এই পৃথ্বী তত্ত্ব থেকে জাত। এরা ঘুম কাতুরে, কিন্তু মানসিক থেকে সহনশীল। এদের সহ্য ক্ষমতা বেশী। ETERNAL PEACE SEEKER - SASANKA SEKHAR PEACE FOUNDATION
Информация по комментариям в разработке