2.4 কার্স্ট ভূমিরূপ (Karst Topography):
যুগোস্লাভিয়ার আড্রিয়াটিক সাগরের পূর্ব তীরে দিনেরিক আল্পস পার্বত্য অঞ্চলে চুনাপাথর গঠিত ‘ক্রাস’ (Kras) মালভূমির নাম থেকে ‘কার্স্ট’ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ‘কার্স্ট’ (Karst) একটি জার্মান শব্দ, যার অর্থ ‘উন্মুক্ত প্রস্তর ক্ষেত্র’ (Bare stone ground)। ইতালিতে আবার এটি ‘কারসো’ (Carso) নামে পরিচিত। কার্স্ট ভূমিরূপ বলতে চুনাপাথরযুক্ত ভূমিরূপকেই বোঝায়। মূলত চুনাপাথর (CaCo3), ডলোমাইট [CaMg(Co3)2] ইত্যাদি কার্বনেট জাতীয় দ্রাব্য শিলা গঠিত অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠীয় ও উপপৃষ্ঠীয় শিলাসমূহ জলের দ্রবণ ক্রিয়ায় দ্রবীভূত হয়ে যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিরূপ ও জলনির্গম প্রণালী গড়ে তোলে , তাকে কার্স্ট ভূমিরূপ বলা হয়। ভূবিজ্ঞানী জেনিনস এর মতে কার্স্ট ভূমিরূপ বলতে ভূমিরূপ ও জলনির্গম প্রণালীর সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য সহ এমন একটি বিশিষ্ট ভূখণ্ডকে বোঝায় যা মূলত শিলার উচ্চ দ্রাব্যতার কারণে প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ দ্বারা সৃষ্টি হয়।
কার্স্ট অঞ্চলে চুনাপাথর ও ডলোমাইট ছাড়াও জিপসাম, রকসল্ট, হ্যালাইট, অ্যানহাইড্রাইট ইত্যাদি খনিজ সমৃদ্ধ শিলার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সেই দিক থেকে ভূবিজ্ঞানীরা কার্স্ট অঞ্চলকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন- চুনাপাথর ও ডলোমাইট গঠিত প্রকৃত কার্স্ট অঞ্চল এবং অ্যানহাইড্রাইট, জিপসাম খনিজ সমৃদ্ধ শিলা গঠিত এভাপোরাইট কার্স্ট অঞ্চল। পৃথিবীর মোট স্থলভাগের মাত্র 10 শতাংশ কার্স্ট অঞ্চল।
কার্স্ট অঞ্চলের অবস্থান-
A) ইউরোপ: i) স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, মন্টেনিগ্রো-বিশ্বের বৃহত্তম কাস্ট অঞ্চল, ii) ফ্রান্সের দক্ষিণ-মধ্য অঞ্চল বা কোসেস, iii) যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ার, ডার্বিশায়ার, মেনডিপ পর্বত, iv) চেক, v) পশ্চিম আয়ারল্যান্ডের বারেন (Burren) কার্স্ট অঞ্চল vi) স্পেনের আন্দালুসিয়া। vii) মধ্য ইউরোপের কার্পেথিয়ান উপত্যকা (হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, সার্বিয়া)
B) উত্তর আমেরিকা: i) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, নিউমেক্সিকো, কেন্টাকি, ইন্ডিয়ানা, পেনসিলভেনিয়া, ভার্জিনিয়া, ii) দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকোর ইউকাটান, তাবাস্কো, iii) পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম কিউবা, জামাইকার ককপিট, উত্তর পুয়ের্তোরিকো।
C) ওশিয়ানিয়া: i) দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া থেকে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বিস্তৃত নাল্লারবোর (Nullarbor) সমভূমির শুষ্ক কার্স্ট মালভূমি অঞ্চল, ii) মধ্য নিউগিনি, iii) দক্ষিণ-পশ্চিম সেলিবিস।
D) এশিয়া: i) দক্ষিণ চিনের গুয়াংসি প্রদেশের গুইলিন, ii) ভিয়েতনাম, iii) ইন্দোনেশিয়া, iv) ভারতের মধ্যপ্রদেশে রাইসেন জেলার ভীমবেটকা গুহা; সাতপুরা পর্বতে; অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমের নিকট অনন্তগিরি পাহাড়ের বোরাগুহালু বা বোরা কেভস, উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন অঞ্চলে পাতাল ভুবনেশ্বর গুহা, সহস্রধারা, রবার্সকেভ (গুচ্ছপানি), তপকেশ্বর; বিহারের গুপ্তধাম গুহা; গুজরাটের সৌরাষ্ট্র উপদ্বীপ; মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির মাওসমাই গুহা, মহারাষ্ট্রের সঞ্জয় গান্ধী জাতীয় উদ্যান গুহা; ছত্তিশগড়ের বাস্তার জেলার কাঙ্গার ভ্যালি জাতীয় উদ্যানে; ঝাড়খন্ডের রাজমহল পাহাড়ে; পশ্চিমবঙ্গের বক্সা ও জয়ন্তী পাহাড়, রাজস্থানের উদয়পুরের নিকট সোরিসা গুহা; মধ্য আন্দামানের বারাটাং দ্বীপে।
কাস্ট ভূমিরূপ বিকাশের আদর্শ অবস্থা (Favourable Conditions for Karst Landform Development) ও আদর্শ কার্স্ট ভূমিরূপের পূর্ণ বিকাশের জন্য কতকগুলি শর্তাবলি প্রয়োজন…..
a) অঞ্চলের বিশালতা: বিশাল আয়তন যুক্ত চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে এই ভূমিরূপ সুস্পষ্টভাবে গড়ে ওঠে। কার্স্ট অঞ্চলটি সুবিশাল হলে দ্রবণের কাজ পরিপূর্ণতা পায় ও সকল ভূমিরূপের উদ্ভব ঘটে।
b) দ্রাব্য শিলার উপস্থিতি: ভূপৃষ্ঠের ওপর বা সামান্য নীচে কার্বোনেট সমৃদ্ধ বিশুদ্ধ চুনাপাথর; এছাড়া চক, ডলোমাইট, জিপসাম প্রভৃতি সহজ দ্রাব্য শিলা থাকা জরুরি।
c) পুরু চুনাপাথরের স্তরের উপস্থিতি: সুস্পষ্ট কার্স্ট ভূমিরূপ গড়ে ওঠার জন্যে পুরু চুনাপাথর স্তরের উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চুনাপাথরের স্তরটি যত বেশি পুরু হয় জলের অনুস্রাবণ তত বেশি হয় এবং কার্স্ট ভূমিরূপ এর বিকাশ পরিপূর্ণ হয়।
উদাহরণ: যুগোস্লাভিয়ার কার্স্ট অঞ্চল 4000 মিটার পুরু।
d) পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত: সমগ্র অঞ্চলটিতে মাঝারি থেকে বেশি পরিমাণে বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাত বেশি হলে জল সহজে নিম্নগামী হয়ে দ্রবণ ক্ষয় দ্রুত করতে পারে। পাশাপাশি ভৌমজলের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন সাধারণত 30 সেমির কম বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে কার্স্ট ভূমিরূপ সুস্পষ্ট ভাবে গড়ে ওঠে না।
(e) নদী উপত্যকার উপস্থিতি : অঞ্চলটিতে নদী উপত্যকার প্রাধান্য থাকলে নদী-ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট ভুমিরূপগুলি সহজেই গড়ে ওঠে।
(f ) ভৌম জলের প্রবাহমানতা: কার্স্ট ভুমিরূপের বিকাশের জন্য ভৌম জলের প্রবাহমানতা থাকা প্রয়োজন।
g) সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পর্যাপ্ত উচ্চতা: সাধারণত চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেকটা উঁচুতে অবস্থান করলে ভৌমজল একটি স্থানীয় ক্ষয়সীমা সৃষ্টি করে দ্রবণ ক্ষয়কে দ্রুততর করে।ফলে কার্স্ট ভূমিরূপ সুস্পষ্টভাবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে।
h) দুর্বল শিলাস্তর : চুনাপাথর স্তরটি ফাটল যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। শিলাস্তরে যত ফাটল জোড় ইত্যাদি থাকবে জল তত সহজে প্রবেশ করে দ্রবণে অংশগ্রহণ করবে।
i) দ্রাব্য শিলাস্তরের নিচে অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের উপস্থিতি : দ্রাব্য শিলাস্তরের নিচে একটি অপ্রবেশ্য শিলাস্তর থাকা প্রয়োজন যাতে দ্রাব্যস্তরে জলের প্রবাহ ঘটে। তবে বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন চুনাপাথর স্তরটির সব জায়গা সমান ভাবে প্রবেশ্য হলে কার্স্ট ভূমিরূপ গঠিত হয় না সেই কারণেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের খড়িমাটি গঠিত অঞ্চলে কোর্স ভূমিরূপ গঠিত হয়নি।
Информация по комментариям в разработке