শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ, দ্বাদশ অধ্যায়, ভক্তি-যোগ, শ্লোক - ৫
ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্ ।
অব্যক্তা হি গতিদুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে ॥ ৫
ক্লেশঃ—ক্লেশ; অধিকতরঃ — অধিকতর; তেষাম্—তাদের; অব্যক্ত—অব্যক্ত- আসক্ত—আসক্ত, চেতসাম্—যাদের মন; অব্যক্তা — অব্যক্ত; হি— অবশ্যই; গতিঃ—গতি; দুঃখম্—দুঃখময়; দেহবডিঃ— দেহাভিমানী জীব দ্বারা; অবাপ
অনুবাদ:
যাদের মন ভগবানের অব্যক্ত নির্বিশেষ রূপের প্রতি আসক্ত, তাদের ক্লেশ অধিকতর। কারণ, অব্যক্তের উপাসনার ফলে দেহধারী জীবদের কেবল দুঃখই লাভ হয়।
তাৎপর্য:
যে সমস্ত অধ্যাত্মবাদীরা ভগবানের অচিন্ত্য, অব্যক্ত ও নির্বিশেষ তত্ত্ব জানবার প্রয়াসী, তাদের বলা হয় জ্ঞানযোগী এবং যারা সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভক্তিযুক্ত চিত্তে ভগবানের সেবা করেন, তাদের বলা হয় ভক্তিযোগী। এখন, এখানে জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের মধ্যে যে পার্থক্য তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। জ্ঞানযোগের পন্থা যদিও পরিণামে একই লক্ষ্যে গিয়ে উপনীত হয়, তবুও তা অত্যন্ত ক্লেশসাপেক্ষ। কিন্তু ভক্তিযোগের পন্থা, সরাসরিভাবে ভগবানের সেবা করার যে পন্থা, তা অত্যন্ত সহজ এবং তা হচ্ছে দেহধারী জীবের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। অনাদিকাল ধরে আত্মা দেহের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। সে যে তার দেহ নয়, সেই ধারণা করাও তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। তাই, ভক্তিযোগী শ্রীকৃষ্ণের অর্চা- বিগ্রহের অর্চনা করার পন্থা অবলম্বন করেন, কারণ তাতে একটি সবিশেষ রূপের ধারণা মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয়। আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, মন্দিরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অর্চা-বিগ্রহের যে পূজা, তা মূর্তিপূজা নয়। বৈদিক শাস্ত্রে সগুণ ও নির্গুণ উপাসনার উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্দিরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহের যে উপাসনা তা সগুণ উপাসনা, কেন না জড় গুণাবলীর দ্বারা ভগবান প্রকাশিত হয়েছেন। কিন্তু ভগবানের রূপ যদিও পাথর, কাঠ অথবা তৈলচিত্র আদি জড় গুণের দ্বারা প্রকাশিত হয়, প্রকৃতপক্ষে তা জড় নয়। সেটিই হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের অপ্রাকৃত তত্ত্ব।
সেই সম্বন্ধে একটি স্থূল উদাহরণ এখানে দেওয়া যায়। যেমন, রাস্তার পাশে আমরা ডাকবাক্স দেখতে পাই এবং সেই বাক্সে আমরা যদি চিঠিপত্র ফেলি, তা হলে সেগুলি স্বাভাবিকভাবে তাদের গন্তব্যস্থলে অনায়াসে পৌঁছে যাবে। কিন্তু যে কোন একটি পুরানো বাক্সে অথবা ডাকবাক্সের অনুকরণে তৈরি কোন বাক্স, যা পোস্ট অফিসের অনুমোদিত নয়, তাতে চিঠি ফেললে কোন কাজ হবে না। তেমনই, মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত ভগবানের শ্রীমূর্তি হচ্ছেন ভগবানের অনুমোদিত প্রতিনিধি, যাকে বলা হয় অর্চাবিগ্রহ। এই অৰ্চাবিগ্রহ হচ্ছেন ভগবানের অবতার। ভগবান সেই রূপের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করেন। ভগবান সর্বশক্তিমান, তাই তিনি তাঁর অর্চা-বিগ্রহরূপ অবতারের মাধ্যমে তাঁর ভক্তের সেবা গ্রহণ করতে পারেন। জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ মানুষদের সুবিধার জন্য তিনি এই বন্দোবস্ত করে রেখেছেন।
সুতরাং, ভক্তের পক্ষে সরাসরিভাবে অনতিবিলম্বে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করতে কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু যাঁরা অধ্যাত্ম উপলব্ধির নির্বিশেষবাদের পন্থা অবলম্বন করেন, তাঁদের সেই পথ অত্যন্ত কষ্টসাপেক্ষ। তাঁদের উপনিষদ আদি বৈদিক গ্রন্থের মাধ্যমে পরমেশ্বরের অব্যক্ত রূপ উপলব্ধি করতে হয়, তাঁদের সেই ভাষা শিক্ষা করতে হয়, অতীন্দ্রিয় অনুভূতিগুলি উপলব্ধি করতে হয় এবং এই সবগুলিই সম্যকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে এই পন্থা অবলম্বন করা খুব সহজ নয়। কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত যে মানুষ সদগুরুর দ্বারা পরিচালিত হয়ে ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করছেন, তিনি কেবলমাত্র
ভক্তিভরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহকে প্রণাম করে, ভগবানের লীলা শ্রবণ করে এবং ভগবানকে নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করে অনায়াসে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করতে পারেন। নির্বিশেষবাদীরা যে অনর্থক ক্লেশদায়ক পন্থা অবলম্বন করেন, তাতে পরিণামে যে তাঁদের পরম তত্ত্বের চরম উপলব্ধি না-ও হতে পারে, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সবিশেষবাদীরা কোন রকম বিপদের ঝুঁকি না নিয়ে, কোন রকম ক্লেশ অথবা দুঃখ স্বীকার না করে পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণারবিন্দের সান্নিধ্য লাভ করেন। শ্রীমদ্ভাগবতে এই ধরনের একটি শ্লোক আছে, তাতে বলা হয়েছে যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শ্রীচরণে আত্মনিবেদন করাই যদি পরম উদ্দেশ্য হয় (এই আত্মনিবেদনের পন্থাকে বলা হয় ভক্তি), তা হলে তা না করে কোনটি ব্রহ্ম আর কোনটি ব্রহ্ম নয়, এই তত্ত্ব জানবার জন্য সারাটি জীবন নষ্ট করলে তার ফল অবশ্যই ক্লেশদায়ক হয়। তাই, অধ্যাত্ম উপলব্ধির এই ক্লেশদায়ক পন্থা গ্রহণ না করতে এখানে উপদেশ দেওয়া হয়েছে, কারণ তার পরিণতি অনিশ্চিত।
জীব হচ্ছে নিত্য, স্বতন্ত্র আত্মা এবং সে যদি ব্রহ্মে লীন হয়ে যেতে চায়, তা হলে সে তার স্বরূপের সৎ ও চিৎ প্রবৃত্তির উপলব্ধি করতে পারে, কিন্তু আনন্দময় প্রবৃত্তির উপলব্ধি হয় না। জ্ঞানযোগের পথে বিশেষভাবে অগ্রণী এই প্রকার অধ্যাত্মবিৎ কোন ভক্তের কৃপায় ভক্তিযোগের পথে আসতে পারেন। সেই সময়, নির্বিশেষবাদের দীর্ঘ সাধনা তাঁর ভক্তিযোগের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তিনি তখন তাঁর পূর্বার্জিত ধারণাগুলি ত্যাগ করতে পারেন না। তাই, দেহধারী জীবের পক্ষে নির্বিশেষ ব্রহ্মের উপাসনা সর্ব অবস্থাতেই ক্লেশদায়ক, তার অনুশীলন ক্লেশদায়ক এবং তার উপলব্ধিও ক্লেশদায়ক। প্রতিটি জীবেরই আংশিক স্বাতন্ত্র্য আছে এবং আমাদের নিশ্চিতভাবে জানা উচিত যে, এই নির্বিশেষ ব্রহ্ম-উপলব্ধি আমাদের চিন্ময় সত্তার আনন্দময় প্রবৃত্তির বিরোধী। এই পন্থা গ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ প্রতিটি স্বতন্ত্র জীবের পক্ষে কৃষ্ণভাবনাময় পন্থা, যার ফলে সে সর্বতোভাবে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হতে পারে, সেটিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা। এই ভগবদ্ভক্তিকে যদি কেউ অবহেলা করে, তা হলে তার ভগবৎ-বিমুখ নাস্তিকে পরিণত হবার সম্ভাবনা থাকে। অতএব অব্যক্ত, অচিন্ত্য, ইন্দ্রিয়ানুভূতির ঊর্ধ্বে যে তত্ত্বের কথা এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, সেই নির্বিশেষ ব্রহ্ম-উপলব্ধির প্রতি, বিশেষ করে এই কলিযুগে আকৃষ্ট হওয়া উচিত নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তা করতে নিষেধ করছেন।
Информация по комментариям в разработке