সদকাতুর ফিতর কি ? সাদাকাতুল ফিতর || আব্দুল মালেক আহম্মেদ মাদানি || আব্দুল মালেক আহম্মেদ মাদানি
আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে যেসব দান প্রদান করা বান্দার ওপর অপরিহার্য, সদকাতুল ফিতর তার অন্যতম। আর্থিক ইবাদত হিসেবে জাকাতের কাছাকাছি পর্যায়ে এর অবস্থান। অধিকাংশ ফিকহি গ্রন্থে জাকাত অধ্যায়েই সদকাতুল ফিতরের আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানুল মোবারকের রোজা ফরজ করা হয়। এ বছরেরই শাবান মাসে সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করা হয়। তাই সামর্থ্যবান প্রতিটি ব্যক্তিকে রমজানুল মোবারকের সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে এ মাসের শেষে সদকাতুল ফিতর আদায়েও যত্নবান হতে হবে।
সদকাতুল ফিতর কী?
সদকাতুল ফিতর মূলত দুটি আরবি শব্দের সমষ্টি। একটি হলো সদকা, অন্যটি ফিতর। সদকা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো দান এবং ফিতর শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উন্মুক্তকরণ বা রোজা ভঙ্গকরণ। ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী রমজান মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত দরিদ্র ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারিত খাদ্যদ্রব্য বা এর সমমূল্য প্রদান করার নিয়মকে শরিয়তের পরিভাষায় সদকাতুল ফিতর বলা হয়। দীর্ঘ এক মাস রোজা পালন করার পর যেহেতু তা ভঙ্গ করা হয় এবং এ উপলক্ষে শরিয়ত কর্তৃক আরোপিত এই দান দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়, তাই একে সদকাতুল ফিতর বলে আখ্যায়িত করা হয়।
ফিতরা আবশ্যক কেন?
ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা পরিমাণ আদায় করা অবধারিত করেছেন। ঈদের নামাজের জন্য বের হবার আগেই লোকজনকে তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (বোখারি : ১৫০৩)।
যা দিয়ে ফিতরা দেওয়া যায়
পাঁচ ধরনের খাদ্যদ্রব্য তথা গম, যব, খেজুর, পনির ও কিসমিসের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। গমের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর আদায় করা হলে অর্ধ সা (এক কেজি ৬৩৫ গ্রাম)-এর মাধ্যমে আদায় করতে হবে। আর যব, খেজুর, পনির বা কিসমিসের মাধ্যমে ফিতরা আদায় করলে সেগুলোর এক সা (তিন কেজি ২৭০ গ্রাম) পরিমাণ দান করতে হবে। এ ব্যাপারে হাদিস শরিফে এসেছে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে বর্তমান থাকা অবস্থায় আমরা সদকাতুল ফিতর বাবদ এক সা খাদ্য (গম) বা এক সা খেজুর অথবা এক সা যব কিংবা এক সা পনির অথবা এক সা কিসমিস দান করতাম।’ (বোখারি : ১৮২৯)।
সে সময় আরব দেশে গম ছিল আমদানি পণ্য; তাই এর দাম ছিল সবচেয়ে বেশি। আমাদের দেশে গমের দাম কম। তাই গম ছাড়া অন্য পণ্যের তুল্য মূল্য করে ফিতরা আদায় করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে কেবল গমের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর আদায় করার রীতি প্রচলিত হয়ে গেছে। অন্য চারটি দ্রব্যের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর খুব কমই আদায় করা হয়। অথচ নিয়ম হলো, প্রতিটি ব্যক্তি তার সামর্থ্য অনুযায়ী সদকাতুল ফিতর আদায় করবে। হাদিসে বর্ণিত উক্ত পাঁচ ধরনের বস্তুর দেশীয় মূল্যের তারতম্যের প্রতি লক্ষ্য করেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এ বছরের সদকাতুল ফিতরের সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করেছে ৭৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করেছে ২৩১০ টাকা। তাই প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ফিতরা দানের দ্রব্য নির্বাচন করে সে অনুযায়ী সদকাতুল ফিতর আদায় করা বাঞ্ছনীয়।
কখন ফিতরা আদায় করবেন?
ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেক উদয় হবার পর সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। তাই ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহে যাবার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। হাদিসে নামাজ আদায়ের আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে যাবার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে সদকা আদায় করল, তাই গ্রহণযোগ্য সদকাতুল ফিতর। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামাজের পর তা আদায় করল, তা সাধারণ দান-অনুদানের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হলো।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৬০৯)।
অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘প্রত্যেক গোলাম, আজাদ, পুরুষ-নারী, প্রাপ্তবয়স্ক, অপ্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের ওপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব এক সা পরিমাণ আদায় করা অবধারিত করেছেন। ঈদের নামাজের জন্য বের হবারে আগেই লোকজনকে তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (বোখারি : ১৫০৩)।
অবশ্য কেউ যদি ঈদুল ফিতর আসার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করে দেয়, তাহলে এরও অবকাশ রয়েছে। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে সালাবা (রা.) বলেন, ঈদুল ফিতরের দুদিন আগে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমরা দুজনের মাঝে এক সা গম কিংবা এক সা খেজুর অথবা যব আদায় করো। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সবার পক্ষ থেকেই তা আদায় করতে হবে।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক সানআনি : ৫৭৮৫)।
সদকাতুল ফিতর কাদের দেবেন?
ইসলাম কর্তৃক যেমনিভাবে জাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারিত রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে সদকাতুল ফিতর ব্যয় করার খাতও নির্ধারিত রয়েছে। জাকাত ব্যয়ের খাত যা, সদকাতুল ফিতর ব্যয়ের খাতও তাই। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে জাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে বলা হয়েছে, ‘জাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত উসুলকারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন, তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এ হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান।’ (সুরা তওবা : ৬০)।
আলোচ্য আয়াতে ‘জাকাত উসুলকারী’ দ্বারা ইসলামি রাষ্ট্রে লোকদের কাছে গিয়ে যারা জাকাত উসুলের কাজ করে, তারা উদ্দেশ্য। আর ‘যাদের চিত্তাকর্ষণ প্রয়োজন’ দ্বারা উদ্দেশ্য এমন নওমুসলিম, যারা নিকট অতীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য তাদেরকে শরিয়ত জাকাত ও সদকাতুল ফিতর ব্যয়ের খাত বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাই আমাদেরকে কোরআন শরিফে বর্ণিত উল্লিখিত খাতেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। নির্ধারিত খাতের বাইরে গিয়ে অন্য কোনো কল্যাণমূলক কাজে সদকাতুল ফিতর ব্যয় করা হলে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
➡️
▶️
Информация по комментариям в разработке