বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতি নিয়ে সারা দেশে নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। গণ দায়মুক্তি সংক্রান্ত এই বিবৃতি নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার ফয়সাল হাসান স্বাক্ষরিত এ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ১৫ই জুলাই থেকে ৮ই অগাস্ট পর্যন্ত সংগঠিত জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না।
এতে বলা হয়েছে, "গত ৫ই অগাস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মাধ্যমে বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে এক নবযাত্রা সূচিত হয়েছে। এ গণঅভ্যুত্থানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে যেসব ছাত্র-জনতা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের মাঠে থেকে এর পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ১৫ই জুলাই হতে ৮ই আগষ্ট পর্যন্ত সংগঠিত জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোন মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না।"
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছে- "এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনা প্রদান করা হলো। এ বিষয়ে অসত্য তথ্য প্রদান করে কোন সুবিধা অর্জনের বিরুদ্ধেও সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হলো।"
তবে বিবৃতিতে জুলাই ও আগষ্ট আন্দোলন চলাকালে কিংবা ৫ই আগষ্টের আগে ও পরে পুলিশ হত্যা, লুটপাটের মতো যেসব অপরাধমূলক ঘটনা সংগঠিত হয়েছে সেসব ঘটনার ক্ষেত্রে কী হবে সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
তবে এটি পরিস্কার যে, নোয়াখালিতে পুলিশ হত্যার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তারের প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এমন নির্দেশনা আসে।
এর আগে নোয়াখালীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতারের পর সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, গ্রেপ্তার হওয়া ছেলেগুলো স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। তারা সমন্বয়ক নন, নিয়মিত আন্দোলনকারীও নন।
তিনি লিখেছেন, ''জনতার ভেতর থেকে কিছু সুযোগসন্ধানী, ভিন্ন উদ্দেশ্যের লোক, থানার অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করে, পুলিশের দিকে গুলি ছুড়ে এবং একজন কনস্টেবলকে পিটিয়ে হত্যা করে।... যে তিনজন ছেলেকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে কথা হচ্ছে, তাদের গ্রেপ্তার করার মূল কারণ ছিল, তাদের মধ্যে একজন, সেদিনের লুট করা অবৈধ অস্ত্রসহ, টিকটকে পোস্ট দেয় ভাব নেওয়ার জন্য।''
প্রসঙ্গত, গণঅভ্যুত্থান চলার সময় শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সাড়ে সাতশোর বেশি মানুষ নিহত হন,আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। অনেক সরকারি-বেসরকারি ভবন ও যানবাহনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। অনেক থানায়, হামলার পর অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের ঘটনাও ঘটে।
এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে মোট ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। নিহত পুলিশ সদস্যদের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে তারা। তাতে দেখা যায় গত ২০শে জুলাই থেকে ১৪ আগষ্টের মধ্যে মোট চুয়াল্লিশ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে থানায় আক্রমণ করে, আগুন লাগিয়ে ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যার ঘটনা। হত্যার পর একজন পুলিশ সদস্যের গলায় ফাঁস দিয়ে, গাছে ঝুলিয়ে রাখার ছবি আসে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে। তিনজন পুলিশ সদস্যকে হত্যার পর পুকুরে ফেলে রাখা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে, অসহযোগের প্রথম দিন, ৪ঠা আগষ্ট রোববার এই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। যদিও ওই ঘটনার পর প্রায় দুই মাস পার হয়ে গেলেও এখনো দায়ীদের গ্রেফতার করা যায়নি।
এদিকে গত ১৫ই সেপ্টেম্বর ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বলেছিলেন, ঢাকায় পুলিশ হত্যা, থানায় অগ্নিসংযোগ ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় মামলা হবে। তিনি তখন বলেছিলেন, “ক্রিমিনাল ইভেন্ট কখনো তামাদি হয় না। পুলিশ হত্যা এবং থানার লুটপাটের ঘটনায়ও মামলা হবে।” যদিও পুলিশ হত্যা, থানা আক্রমণ, হামলা বা লুটপাটের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কী ৪৪ জন পুলিশ হ্ত্যা ও থানায় হামলা, অস্ত্র গোলাবারুদ লুটকারিরা গণ দায়মুক্তি পেয়ে গেল?
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা—আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান বলেন, ফৌজদারি অপরাধে কাউকেই দায়মুক্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। এখন যেসব চেষ্টা চলছে, এগুলো বেআইনি চেষ্টা। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনাও আছে। অপারেশন ক্লিনহার্টের ঘটনায় হাইকোর্টে যে রিট করেছিলাম, সেখানে পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া হয়েছিল, হত্যার শিকার পরিবারগুলো প্রতিকার চেয়ে মামলা করতে পারবে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেছেন, ফৌজদারি অপরাধ থাকলে সেটি নির্দেশনা দিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার বাহিরে রাখার সুযোগ থাকে না।
প্রসঙ্গত ২০০২ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ বাহিনী অপারেশন ক্লিনহার্ট পরিচালনা করে। সেই অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু হয়। অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে সংসদে আইন পাস করা হলেও একটি রিট আবেদনের পর ২০১৫ সালে সেই আইন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট।
Информация по комментариям в разработке