রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নে ঘাগড়া (বহুমুখী) উচ্চ বিদ্যালয় হঠাৎ করেই ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে গেছে।
বাংলাদেশের যে নারী ফুটবল দলটি সাফের শিরোপা নিয়ে এসেছে, সেই দলের পাঁচজন খেলোয়াড় উঠে এসেছেন এই একটি স্কুল থেকে। এরা হলের মনিকা চাকমা, আনাই মগিনী, আনুচিং মগিনী, রিতুপর্ণা চাকমা ও সেরা গোলরক্ষক রূপনা চাকমা।
এ বিদ্যালয়ের ফুটবল প্রশিক্ষক শান্তিমনি চাকমা ও মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা, আর ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ানের ভূমিকা অনন্য।
মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ান পর ভীষণ গর্বিত এই তিনজন। কিন্তু কৃতিত্ব নিতে একটুকু চেষ্টাও নেই তাদের। বরং একজন বলেন আরেকজনের কথা। সেই সঙ্গে তুলে ধরছেন মেয়েদের পরিশ্রমের বিষয়টি।
পাহাড়ের সেরা এ পাঁচ তারকার এক জায়গায় নিয়ে আসতে প্রধান ভূমিকা রাখেন বীরসেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে ফুটবল খেলোয়াড় সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাই তার শখ। আর সেসব খেলোয়াড়ের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দিতেন ফুটবল প্রশিক্ষক শান্তিমনি চাকমাকে।
আর মেয়েদের আবাসনের জন্য উদ্যোগ নেন চন্দ্রা দেওয়ান। আনসার ভিডিপির কোচ সুইলা মং মারমা ও ধারজ মনি চাকমাও সহযোগিতা করেন তাদের।
রূপনাদের গড়ে তুলছেন, কৃতিত্ব নিতে আগ্রহ নেই
স্কুলের মাঠে স্থানীয় কোচের সঙ্গে নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা। ছবি: সংগৃহীত
পাঁচ তারকার মধ্যে আনাই মগিনী, আনুচিং মগিনী, মনিকা চাকমা খাগড়াছড়ি জেলার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে সবচে দুর্গম লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা থেকে ঘাগড়ায় চলে আসেন মনিকা।
রিতুপর্ণা চাকমার বাড়ি ঘাগড়া এলাকাতেই। আর রূপনার বাড়ি নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ভূঁইয়ো আদামে।
রিতুপর্ণা এই স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বিকেএসপিতে চলে যান। রূপনা এখনও দশম শ্রেণিতে পড়ে। বাকিরা এখান থেকেই এসএসসি পাস করেন।
এই স্কুলে ফুটবলার তৈরির কার্যক্রম জেনে এসেছে নিউজবাংলা।
শান্তিমনি চাকমার নির্দেশনায় প্রতিদিন ভোর ৬টা ও বিকেল ৪টায় স্কুল মাঠে চলে প্রশিক্ষণ। সেখানে মেয়েদের জন্য করা হয়েছে হোস্টেলের ব্যবস্থাও। ফুটবলপ্রেমী মেয়েরা বাড়ি ছেড়ে থাকে এখানে।
রূপনা, মগিনী, মনিকারা স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে অন্যদের মধ্যেও। তারাও লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়।
জাতীয় দলে খেলবে এমন আশায় জোর অনুশীলন করে যাচ্ছে নবম শ্রেণির ছাত্রী নবনিতা চাকমা। সে বলে, ‘মনিকা, আনাই, আনু, রিতু, রূপনা দিদিদের মতো বড় খেলোয়াড় হতে চাই। আমাদের সকাল-বিকেল প্রতিদিন ফুটবলে অনুশীলন করাচ্ছেন শান্তিমনি স্যার।’
একদিন জাতীয় দলের খেলোয়াড় হব’- আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে নবম শ্রেণির জুলেখা চাকমাও। সে বলে, ‘বাংলাদেশের মেয়েরা এবার যে বিজয় লাভ করেছে তাতে আমি খুব খুশি।’
হোস্টেলে থেকে এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে মেন্টি চাকমা। পড়াশোনার চাপের মধ্যেও ফুটবলের অনুশীলন থেমে নেই তার।
মেন্টি বলে, ‘ফুটবলকে ভালোবেসে স্কুলের হোস্টেলে থাকি, যাতে একদিন স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।’
ঘাগড়া ইউনিয়নের সাবেক সদস্য শান্তিমনি চাকমা বলেন, ‘যদি সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয়, তাহলে ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আরও অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় উঠে আসবে।’
এই শান্তিমনি ফুটবল প্রশিক্ষক শান্তিমনি নন। তিনি জানান, মনিকা, আনাই, আনুচিং ও রিতু প্রাথমিকের বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট খেলেছিল। তারা মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর তাদের বর্তমান পর্যায়ে উঠে আসার পেছনে কারিগর ছিলেন বীরসেন চাকমা। তিনি ছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
বীরসেন যতটা করেছেন, তাতে খুশি নন। বরং আরও অনেক কিছু করার ছিল ভেবে আক্ষেপ করেন।রূপনাদের গড়ে তুলছেন, কৃতিত্ব নিতে আগ্রহ নেই
মনিকা, আনাই, আনুচিং, রিতুপর্ণা ও সেরা গোলরক্ষক রূপনা চাকমাদের স্কুল, ঘাগড়া (বহুমুখী) উচ্চ বিদ্যালয়। তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ঘাগড়ার মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু জেলা পর্যায়ে কোনো ক্লাবই তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, যখন আনু, মনিকা, আনাই, রিতু বঙ্গমাতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তখন তাদের প্রতিভা ধরে রাখতে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও পৌরসভা মেয়রের কাছে গিয়েছিলাম। নিজের জন্য না, খেলোয়াড়দের জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো সহযোগিতাই দেয়নি।’তিনি বলেন, ‘মেয়েরা এতদূর আসার পেছনে শান্তিমনি চাকমা, সুইলা মং মারমা, চন্দ্র বিকাশ দেওয়ানসহ অনেকে ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের এ অর্জনে মনে হচ্ছে যেন চ্যাম্পিয়ন আমি নিজে হয়েছি।’
এবার কথা হলো সেই শান্তিমনি চাকমার সঙ্গে, যিনি তৈরি করেছেন রূপনাদের। তিনি বলেন, ‘মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমার দাদার পরামর্শে ২০১১ সালে বাচ্চাদের নিয়ে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করা এবং চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করা। পরে সব খেলোয়াড়কে একত্র রাখতে ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়।
‘সেখানে এসে তাদের প্রশিক্ষণ দিই। এভাবে ধাপে ধাপে তারা শিরোপা অর্জন করে। একপর্যায়ে ভালো খেলাতে তারা ফেডারেশনে ডাক পায়। আজ তারা জাতীয় দলের সেরা খেলোয়াড়। এর পেছনে যিনি ভূমিকা রেখেছেন বীরসেন দাদার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
নিজের কৃতিত্ব কি একটুকুও নেবেন না শান্তিমনি? তিনি বলেন, ‘তাদের প্রতিটি খেলা দেখেছি। চমৎকার খেলেছে। আমার পরিশ্রম কিছু মনে করি না। তাদের চ্যাম্পিয়ন দেখে নিজেকে গর্ববোধ মনে করি।
ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে শুধু নারী ফুটবলাররা কেন উঠে এসেছে..?। ছেলেদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই কি না জানতে চাইলে শান্তিমনি বলেন, ‘এর আগে ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। কিন্তু ছেলেরা এক দিন এলে তিন দিন আসত না। নিয়মিত অনুশীলন হতো না। নারী ফুটবলাররা মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করার কারণে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।’
Информация по комментариям в разработке