•• পুজোয় পড়া? ••
— অ্যাই ভেবলু, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কী করছিস রে? বলি সন্ধ্যা কতক্ষণ হলো, বল তো? পড়তে বসবি আয়!
— দাঁড়াও না মা! একটু দেখতে দাও না। দেখো টুকাই দাদা, মিষ্টি, বাবলু, লিলি দিদি'রা কী সুন্দর বাজি ফাটাচ্ছে!
— ওরা দুপুর বেলা সবাই পড়া করে নিয়েছে; তাই এখন বাজি ফাটাচ্ছে। তুই তো তখন ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছিলি। পড়াগুলো তখন করে রাখিসনি, এখন আমি কী করবো? পড়তে তো বসতেই হবে।
— আজকের বাদ দিলে হয় না, মা? কাল থেকে ঠিক বসবো।
— এই, এই হাতের খুন্তিটা দেখেছিস তো? পিঠে পড়লে বুঝবি তখন! মাথা গরম করাবি না। এই আজ বসবো না, কাল বসব করে করে তোর কাল হলো, বুঝলি? আর কয়েকদিন পরেই তো স্কুল খুলবে তারপর এক মাস হতে না হতেই টার্মিনাল পরীক্ষা! তখন কি দুটো গোল্লা নিয়ে আসবি পরীক্ষার খাতায়?
বছর দশেকের ভেবলু'র মাথায় বিভিন্ন চক্রান্ত চলতে থাকে কী করে আজ এই পড়াশোনা ব্যাপারটা থেকে বিরতি নেওয়া যায়। এখন এই পুজোর আমেজে পড়া কি মাথায় ঢোকে? আজকাল তো বই-খাতা খুললেই পড়াগুলো সব মাথার দশ ফুট উপর দিয়ে... না না বরং বাজপাখি, চিল কিংবা ঈগল যে উচ্চতায় ওড়ে তারও উপর দিয়ে পড়াগুলো কোথায় যেন বেরিয়ে চলে যায়। ওর মাথার কাছাকাছি আর পৌঁছায় না।
— কিরে, কথাগুলো কানে যাচ্ছে না তাই না? যাব আমি? শুধু রান্নাঘরে কড়াইটা চাপিয়েছি বলে আসতে পারছি না। নইলে দেখতিস আমার কথা অমান্য করার কি শাস্তি হতে পারে।
খানিক ভয় পেয়েই ব্যালকনিতে আর লাফালাফি না করে পড়ার ঘরে চলে আসে ভেবলু। লক্ষী পুজো হয়ে গিয়েছে ঠিক, কালীপূজা আসতে এখনও সপ্তাহ খানেক বাকি। তাও কত মানুষ বাজি ফাটাচ্ছে এখন থেকেই।
— অ্যাই ভেবলু, পড়তে বসলি? আগে অংক খাতাটা খোল। কাল আন্টি পড়াতে আসবে না?
— হ্যাঁ, এই তো খুলেছি।
মনকে যতটা সম্ভব মেরে ভেবলু অংক গুলো দেখতে থাকে। মোটামুটি সবগুলো জানা অংকই রয়েছে সেগুলোকে সাত তাড়াতাড়ি শেষ করে নেয় ও। আর দু-তিনটে অংক এখন যেন কিছুতেই মনে পড়ছে না কোন নিয়মে করতে হয়...
এই পাঠ গুছিয়ে ও একটু রান্নাঘরে উঁকি মারতে যায়। কিন্তু রান্নাঘরে তো ওর মা নেই, কোথায় গেল?
— ওরকম চোরের মতন তাকিয়ে লাভ নেই, চল এখন ইতিহাসটা রিভাইস করে নে, যা পড়িয়ে ছিল সেদিন।
পিছনে বনানী দেবী'কে দেখে চমকে ওঠে ভেবলু।
এক একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে থাকেন বনানী দেবী। প্রায় সবকটার উত্তরই ভুল। কারণ ভেবলু'র চোখ ব্যালকনির সামনে উড়তে থাকা বারুদের ধোঁয়ার দিকে।
— এতটা অধঃপতন হয়েছে তোর, ভেবলু? একটাও মনে নেই তোর? সবাই দেখবি ভালো রেজাল্ট করবে আর তুই ওই একই ক্লাসে বসে থাকবি জুনিয়রদের সাথে পড়বি এবার। বুঝলি তো?
প্রেশার কুকারে সিটি পড়ার আওয়াজ হয়! বনানী দেবী তাড়াতাড়ি উঠে যেতে যেতে বলেন,
— তুই পড, আমি এই শেষ রান্নাটা সেরে নিয়ে আবার বসবো ইতিহাসটা নিয়ে। ওটার বড্ড খারাপ অবস্থা! জোরে জোরে পড়, আমি যেন শুনতে পাই!
কিছুক্ষণ গোঁ গোঁ করে পড়ার পর এই পড়াশোনা ব্যাপারটাই ওর কাছে অত্যন্ত বিরক্তিকর মনে হয়। বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি যেন আরও বেড়ে চলেছে। এবার বোধহয় চিন্টু, পল্টু, শাক্য— এরা সকলে চলে এসেছে বাজি পোড়ানোর জন্য।
হাত-পা নিশপিশ করতে থাকে ওর বাইরে যাওয়ার জন্য।
— কিরে ভেবলু, গলার আওয়াজ থেমে গেল কেন?
— এই যে মা, জল খেতে উঠলাম, তাই।
জল খাওয়ার নাম করে ভেবলু ধীরে ধীরে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। খুঁট্ করে একটা শব্দ হয়। পা টিপে টিপে ও ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে। বনানী দেবী রুটি বেলার বেলন নিয়ে পড়ার ঘরে ঢুকে দেখেন... ভেবলু ভ্যানিশ! হাতের বেলন নিয়েই উনি নীচে রাস্তার দিকে দৌড়ে যান। সবে সবে একটা তুবড়ি আর দু-তিনটে চরকি জ্বালানো হয়েছে। ভেবলু সেখানেই উদ্দাম ভাবে নাচানাচি করছে।
— অ্যাই ভেবলু, তুই পালিয়ে এলি এভাবে? দ্যাখ, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন!
— নেহি মাতে! ডোন্ট টাচ মি। এই পড়াশোনা এখন ভেবলু'কে টাচ করতে পারবে না; ওসব কালীপুজোর পরে হবে।
— পাকা পাকা কথা, না? আজ রাতে তোর বাবা আসুক...
বনানী দেবী এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারেন না ওকে। সোসাইটিতে কত লোক আছে। বাচ্চারা সকলে খেলছে, কি আর বলবেন উনি! যুদ্ধে হেরে যাওয়া রাজার মতন উনিও পিছনে লুকিয়ে রাখা বেলন নিয়ে উপরে উঠে যান।
.
.
.
.
• কলমে:- সৌমিলি
• চিত্রাঙ্কনে:- Chitro-Gupter Khata
©swapnotori
Информация по комментариям в разработке