প্রত্যেকবার দুর্গাপুজো শেষ হওয়ার পর, বাংলার মাঠ ঘাট শহর নগরের বাতাসে ভাসতে থাকে একটি প্রশ্ন, "আগামী বছর কিসে আসছেন মা?" দ্য ওয়ালের এই ভিডিওটি সম্পূর্ণ দেখে এরপর থেকে আপনিও অনায়াসে বলে দিতে পারবেন এবছর মা কোন বাহনে ধরাধামে আসছেন এবং কৈলাসে ফিরে যাবেন কোন বাহনে চড়ে। এমন কি বলে দিতে পারবেন, আগামী বছর মা কোন বাহনে বাপেরবাড়ি আসবেন ও কোন বাহনে কৈলাসে ফিরে যাবেন।
আমরা জানি প্রত্যেক দেবদেবীরই নিজস্ব বাহন আছে। সেই বাহনে করেই তাঁরা স্বর্গ ও মর্ত্য ভ্রমণ করেন। যেমন শ্রীবিষ্ণু ত্রিলোক পরিক্রমা করেন গরুড়ের পিঠে। বাবা ভোলানাথ পাহাড় পর্বতে ঘুরে বেড়ান ষাঁড় নন্দীর পিঠে চড়ে। এমনকি নারদও ত্রিলোক ভ্রমণ করেন ঢেঁকি চড়ে। কিন্তু মা দুর্গা তাঁর নিজের বাহন সিংহ থাকা সত্ত্বেও হাতি, ঘোড়া, দোলা ও নৌকোয় চেপে বাপের বাড়ি আসেন কেন! প্রশ্নটির উত্তর লুকিয়ে আছে মায়ের অষ্টোত্তর শতনামের মধ্যে থাকা একটি নামে। সেটি হলো ' সর্ববাহনবাহনা'।
মা ভবানী পৃথিবীতে আসেন শরৎ ঋতুতে। পৃথিবী তাঁর বাপের বাড়ি, যেখানে কেউ সিংহের পিঠে চেপে ঘোরাফেরা করে না। প্রাচীনযুগ থেকেই পৃথিবীর মানুষ আসা যাওয়ার প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে গজ বা হাতি, ঘোটক বা ঘোড়া, নৌকো এবং দোলা বা পালকি। তাই সনাতনী শাস্ত্রজ্ঞরা ঘরের মেয়ে উমার জন্যও পৃথিবীতে বহুল ব্যবহৃত যানবাহনেরই ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন।
প্রাচীনযুগের মুনি-ঋষিরা দেখেছিলেন এই সমস্ত যানবাহনে করে প্রতিবছর গমনাগমনের পর পৃথিবীর ওপর শুভ অশুভের প্রভাব পড়ে। বসুন্ধরা যেমন শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনই ধরাধামের বুকে দেখা দেয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ধ্বংস ও মৃত্যুর মতো অশুভ ঘটনা। বহু শতাব্দী ধরে পৃথিবীতে মায়ের গমনাগমন ও পরবর্তী ঘটনাক্রমের ওপর নজর রেখে সনাতনী শাস্ত্রজ্ঞেরা বুঝেছিলেন সৃষ্টির সঙ্গে ধ্বংসও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে। কেবলমাত্র সৃষ্টিই আবর্তিত হলে সৃষ্টির প্রাচুর্যে ধরাধামে দেখা দেবে মহাপ্রলয়। তাই মা সৃষ্টির সঙ্গে মর্ত্যে নিয়ে আসেন বিনাশও।
গমনাগমনের সময় হিমালয়দুহিতা কখন কোন বাহন ব্যবহার করবেন, সনাতনী শাস্ত্রজ্ঞেরা সে সবও সূত্রাকারে লিখে গিয়েছেন দিন, তিথি ও নক্ষত্র বিচার করে। তাঁরা লিখে গিয়েছেন গজ, দোলা, ঘোটক ও নৌকা চড়ে মর্ত্যে আসার পর কী কী প্রভাব পড়তে পারে পৃথিবীর ওপর। গমনাগমনের সূত্রটি হলো “রবৌ চন্দ্রে গজারূঢ়া, ঘোটকে শনি ভৌময়োঃ, গুরৌ শুক্রে চ দোলায়াং নৌকায়াং বুধবাসরে।”
শাস্ত্রে বলেছে "রবৌ চন্দ্রে গজারূঢ়া"। সনাতনী শাস্ত্রে লেখা রয়েছে, যদি কোনও বছর রবিবার বা সোমবার সপ্তমী পড়ে, তাহলে মা ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন গজ বা হাতিতে চেপে। মায়ের বিদায়ের দিন অর্থাৎ দশমীর দিনটিও যদি রবি বা সোমবার হয়, তাহলে মা কৈলাসে ফিরে যাবেন গজে চড়েই।
দেবীর গজে গমনাগমনের প্রভাব কী হবে তাও জানিয়েছে সনাতনী শাস্ত্র।- শাস্ত্র বলছে “গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা”। এর অর্থ, মা যদি গজে আসেন তাহলে আগামী এক বছর পৃথিবী হবে শস্যশ্যামলা। পৃথিবীতে জলাভাব দেখা দেবে না। অন্যদিকে গজ যেহেতু বিশ্বকর্মার বাহন তাই কৃষিকাজের পাশাপাশি উন্নতি ঘটবে শিল্পেরও। সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে বসুন্ধরা৷
এরপর শাস্ত্র বলেছে "ঘোটকে শনি ভৌময়োঃ"। এর অর্থ হলো যদি সপ্তমী ও দশমী তিথি পড়ে শনিবার বা মঙ্গলবার, তাহলে মায়ের আগমন ও বিদায় হবে ঘোটকে বা ঘোড়ায় চেপে।
দেবীর ঘোটকে গমনাগমনের প্রভাব বোঝাতে শাস্ত্র বলছে “ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে”। এর অর্থ আগামী এক বছর ধরে পৃথিবী জুড়ে বিরাজ করতে থাকা শান্তি ও শৃঙ্খলা ছত্রভঙ্গ হতে থাকবে। পৃথিবীতে দেখা দেবে অস্থিরতা, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধ, দুর্ঘটনা, ক্ষয়ক্ষতি ও অপমৃত্যু। আসলে ঘোড়া প্রাণী হিসেবে অস্থির। সর্বক্ষণ সে ছুটতে চায়। কখনও কখনও সে প্রভুর অবাধ্য হয়ে ছুটতে শুরু করে অভীষ্ট লক্ষ্যের বিপরীত দিকে। তখন তাকে বশে আনতে বেগ পেতে হয় প্রভুকে। ঘোড়ার অস্থিরমতির কথা বিবেচনা করেই শাস্ত্রজ্ঞেরা সম্ভবত এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন।
মা আসেন নৌকাতেও। শাস্ত্র বলেছে "নৌকায়াং বুধবাসরে"। শাস্ত্রমতে যদি কোনও বছর সপ্তমী ও দশমী তিথি বুধবারে পড়ে, তাহলে মহিষাসুরমর্দিনীর গমনাগমন হবে নৌকায় চেপে।
দেবী নৌকায় গমনাগমনের কী প্রভাব পড়বে পৃথিবীর ওপর তাও বলেছে শাস্ত্র। শাস্ত্রে বলেছে “শস্যবৃদ্ধিস্তুথাজলম”। এর অর্থ আগামী এক বছরে শস্যের অকল্পনীয় ফলন হবে। কিন্তু পৃথিবীতে দেখা দেবে প্রবল জলস্ফীতি। ফুঁসে উঠবে সপ্তসাগর। দেখা দেবে অতিবৃষ্টি। নদী নালা খাল বিল উপচে ধরাধামে দেখা দেবে বন্যা। নষ্ট হবে ফসল, এর প্রভাবে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।
দেবী দুর্গার সর্বশেষ বাহন হলো দোলা। পুরাণে বলা আছে 'গুরৌ শুক্রে চ দোলায়াং'। যে বছর সপ্তমী এবং দশমী বৃহস্পতিবার অথবা শুক্রবারে পড়বে সেই বছর মা দুর্গার আগমন ও বিসর্জন ঘটবে দোলায়।
দোলায় গমনাগমনের প্রভাব কী হবে ? শাস্ত্রে বলেছে “দোলায়াং মরকং ভবেৎ”। চার প্রকার যানবাহনের মধ্যে দোলাকেই সবচেয়ে অশুভ বলে জানিয়েছেন শাস্ত্রজ্ঞেরা। কারণ দোলা সর্বদা দোদুল্যমান। দোলার কোনও স্থিরতা নেই। তাই মর্ত্যের শান্তি শৃঙ্খলা ও জীবনের স্থিরতা বিঘ্নিত হওয়ার প্রতীক হল দোলা। দেবীর গমনাগমন দোলায় হলে আগামী একবছর পৃথিবী জুড়ে দেখা দিতে পারে মড়ক। মহামারি, মন্বন্তর, যুদ্ধ, খরা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি এবং বহু মানুষের অকালমৃত্যু হতে পারে।
শাস্ত্রের ব্যাখ্যায় এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, চার যানবাহনের মধ্যে কেবলমাত্র গজকেই সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করেছেন আদ্যাশক্তি মহামায়া। বাকি তিন যানবাহনকে ব্যবহার করেছেন ধ্বংসের কাজে। আসলে মা দশভূজা সত্যানন্দস্বরূপিণী হলেও তিনিই যে সর্বদানবঘাতিনী।
Информация по комментариям в разработке