শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, চতুর্থ অধ্যায়, জ্ঞানযোগ, শ্লোক ১৩ Srimadbhagavad Gita, Chapter 4, Verse No 13, নিবেদনে : গৌরমোহন দাস
ওঁ তৎ সৎ। ওঁ আচার্য দেবো ভবঃ। ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়ো।
আসুন, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার কথায় দিন শুরু করি : শ্লোকভিত্তিক ধারাবাহিক আলোচনায় আজ আমরা জানবো- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, চতুর্থ অধ্যায়, জ্ঞানযোগের শ্লোক নম্বর ১৩ এর কথা। ৯ নম্বর শ্লোকে ভগবান বলেছেন- ভগবানের জন্ম ও কর্ম দিব্য, যথার্থভাবে জানলে ভগবান প্রাপ্তি হয়। জন্মের দিব্যতার কথা ভালোভাবে আলোচনা হয়েছে। কর্মের দিব্যতার বিষয়ে স্পষ্ট করতে এবার নিজ কর্মে কর্তৃত্ব,বৈষম্য ও স্পৃহার অভাব দেখিয়ে নিজ কর্মের দিব্যতার কথা জানাচ্ছেন। শ্লোকটি সনাতনধর্মে গুরুত্বপূর্ণ সুনির্বাহিত একটি শ্লোক। এ শ্লোকে ভগবান বলছেন :
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।।
সহজ উচ্চারণ-
অনুবাদ- গুণ ও কর্মের বিভাগ- অনুসারে মানব সমাজে চারটি বর্ণ আমি সৃষ্টি করেছি, কিন্তু এর সৃষ্টিকর্তা আমি হলেও আমাকে অকর্তা ও অব্যয় বলে জানবে।
#গীতার_শ্লোকের_প্রাসঙ্গিক ও #সরল_আলোচনা : চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং মানে চার বর্ণ আমা কর্তৃক সৃষ্টি হয়েছে। চার বর্ণ কী কী? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। কেন কীভাবে সৃষ্টি করেন? গুণকর্মবিভাগশঃ মানে গুণ ও কর্মের মাধ্যমে। গুণ মানে হলো- প্রকৃতিজাত স্বত্ব, রজঃ এবং তমো।
এখন প্রশ্ন হতে পারে সমদর্শী ভগবান চারবর্ণ সৃষ্টি করে বৈষম্য তৈরি করলেন কেন? এ বিষয়ে শুরুতেই একটি উপমা দিলে আমাদের পরিস্কার ধারণা হতে পারে। স্কুলে পড়ার সময় স্কুল শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের যোগ্যতা অনুসারে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে। যেমন : ক বিভাগ, খ বিভাগ, গ বিভাগ ইত্যাদি। যে যে শ্রেণির যোগ্যতা রাখে তাকে সে শ্রেণিতে বসানো হয়। ছাত্র হিসেবে সকলই সমান। কিন্তু যোগ্যতা অনুসারে আলাদা আলাদা বসানো হয়েছে। তেমনি আমাদের গুণ ও কর্ম অনুসারে ভগবান চারটি বিভাগে বিভক্ত করেছেন।
১। যার মধ্যে স্বত্ত্ব গুণ প্রবল তাকে ব্রাহ্মণ। ২। যার মধ্যে স্বত্ত্ব ও রজোগুণ মিশ্রিত তাকে ক্ষত্রিয়। ৩। যার মধ্যে তমোগুণের মিশ্রিত রজোগুণ বেশি থাকে তাকে বৈশ্য এবং ৪। যার মধ্যে রজোগুণ মিশ্রিত তমোগুণ বেশি থাকে- শূদ্র বলা হয়। এই চার বর্ণের কার কী কাজ সে বিষয়ে গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৪২ থেকে ৪৪ শ্লোকে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ভগবান।
১। শম. দম, তপ, শৌচ, ক্ষান্তি, সরলতা, শাস্ত্রজ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য নয়টি ব্রাহ্মণের কর্ম। যে বা যিনি এ কাজগুলো করেন না তিনি ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম গ্রহণ করলেও ব্রাহ্মণ নন। “ব্রহ্ম জানাতি ইতি প্রকৃত ব্রাহ্মণ।” যার কারণে গাদির পুত্র বিশ্বামিত্র ছিলেন ব্রাহ্মণ যদিও গাদি ছিলেন ক্ষত্রিয়। আবার শূদ্রের পুত্র রত্নাকর ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন করে হয়েছিলেন ব্রাহ্মণ। তার নাম হয় ঋষি বাল্মিকী এবং তিনিই রামায়ণ রচনা করেছিলেন। এখানেই প্রমাণিত হয় যে ক্ষত্রিয় বা শূদ্রের ছেলেও ব্রাহ্মণ হতে পারে-কর্মেরগুণে।
২। শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, যুদ্ধে পিছিয়ে না আসা, দানশীলতা ও শাসন ক্ষমতা এগুলো ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম। রাবণ জন্মেছিলেন ঋষি পুলৎস্যের ঘরে কিন্তু পরে রাক্ষস হন। প্রবৃদ্ধ ছিলেন রাজা রঘুর পুত্র কিন্তু পরে রাক্ষস হন। ত্রিশঙ্কু ছিলেন একজন রাজা যিনি পরে চণ্ডাল হন। বিশ্বামিত্রের পুত্রেরা শূদ্র হন। বিশ্বামিত্র নিজে ছিলেন ক্ষত্রিয় যিনি পরে ব্রাহ্মণ হন।
৩। কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যের স্বাভাবিক কাজ। এবং ৪। পরিচর্যা শূদ্রের স্বভাবজাত কর্ম।
এ বিষয়ে বেদের এই শ্লোককে স্মরণে আনা যেতে পারে।
ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীৎ বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।
ঊরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।।
ব্রহ্মপুরুষের মুখ হতে ব্রাহ্মণ, বাহু হতে ক্ষত্রিয়, ঊরু হতে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্রের উৎপত্তি। (ঋগ্বেদসংহিতা দশম মণ্ডল, ৯০ নং সূক্ত, মন্ত্র ১২) অর্থাৎ যিনি প্রতিনিয়ত মুখের ব্যবহার করে অন্যকে শিক্ষা দান করেন তিনি ব্রাহ্মণ। যেমন : একজন শিক্ষক। যিনি বাহুর ব্যবহারে দেশের শান্তি বজায় রাখেন, তিনি- ক্ষত্রিয়। যেমন : সৈনিকগণ। এমনিভাবে বৈশ্য ধনের দ্বারা, শূদ্র শারীরিক পরিশ্রম দ্বারা একে অন্যের মঙ্গল করেন, সমাজের শক্তি ও শ্রীবৃদ্ধি করেন।
আমরা ভগবানের কথাকে না মেনে গুণ ও কর্ম না থাকলেও ব্রাহ্মণের ছেলে ব্রাহ্মণ, শূদ্রের ছেলে শূদ্র মেনে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে থাকি। বিবাহও বন্ধ রাখি। ফলে তারা অন্য ধর্মমতেও যেতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। যা দুঃজনক। অথচ ভগবান এ চার বর্ণ সৃষ্টি করেছেন সকলের সমন্বয়ের জন্য।
শ্লোকের শেষে ভগবান বলেছেন- তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।। মানে আমাকে এসবের অকর্তা বলে জানবে। ভগবান সর্বোতভাবে উদাসীন, কোনো কর্মের রাগ দ্বেষ বা কর্তৃত্ব থাকে না। জাতি কুলের অতীত শ্রীভগবান।
শেষ করি এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর একটি কথা দিয়ে -' মুচি হয়ে শুচি হয় যদি কৃষ্ণ ভজে।/ শুচি হয়ে মুচি হয় যদি কৃষ্ণ ত্যাজে।' সকলের মাঝে কৃষ্ণভক্তি জাগ্রত হোক শেষ প্রত্যাশায় আজকের আলোচনার বিশ্রাম টানছি। বিশ্বের সকল জীবের ত্রিবিধ মঙ্গল হোক। - ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি। জয়গীতা। জয় শ্রীকৃষ্ণ।
নিবেদনে-
শ্রী গৌরমোহন দাস
সাংগঠনিক সম্পাদক
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি
এবং
কণ্ঠধ্বনিতে রয়েছেন- শ্রীমতী সরস্বতী কর Saraswati Kar
Информация по комментариям в разработке