Скачать или смотреть বাজিতপুর লাইব্রেরীয়ান কমরেড অধ্যাপক ননী গোপাল শর্মা আমাদের মাঝে আর নেই ।। চলে গেলেন না ফেরার দেশে

বাজিতপুর লাইব্রেরীয়ান কমরেড অধ্যাপক ননী গোপাল শর্মা আমাদের মাঝে আর নেই ।। চলে গেলেন না ফেরার দেশে ।।
একজন কীর্তিমান লাইব্রেরীয়ান ননী গোপাল শর্মা
মোহাম্মদ খলিলুর রহমান, বাজিতপুরঃ
সমাদৃত অধ্যাপক ননী গোপাল শর্মা। ‘শর্মা বাবু’, ‘শর্মা স্যার’ বলে-ই যিনি বহুল পরিচিত। জীবন চলার পথে হাঁটতে গিয়ে তিনি বহু বিচিত্র পথে হেঁটেছেন। হাঁটতে হাঁটতে, চলতে চলতে তিনি এখন বার্ধক্যের প্রায় চুড়ান্ত দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু চলা যেন তাঁর থামেনি। তিনি চলছেন তো চলছেন-ই। এ চলার যেন আর শেষ নেই। কেবল অন্তিম, চির বিদেয়ের অমোঘ অনিবার্য সত্য এসেই মানব কল্যাণে নিয়ে যেতে পারে মরনোত্তর মরদেহ ।

বেশ কিছু দিন ধরে বাজিতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি কমরেড ননী গোপাল শর্মা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একজন কীর্তিমান লাইব্রেরীয়ানের গুণকীর্তি লেখার সাধ্য কি আমার আছে ।

বাজিতপুর তথা ভাটি অঞ্চলের পরিচিত মুখ, প্রগতিশীল আপোষহীন প্রতিশ্রুতিশীল বুদ্ধিজীবী, সর্বস্বত্যাগী, গণমানুষের নিরন্তর কল্যাণে যিনি নিয়োজিত এমনি একজন নিরহংকার অসাধারণ মানুষটির জন্ম ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ এর ৫ জুলাই ময়মনসিংহের তারাকান্দা থানার ঢাকুয়া গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় ললিত মোহন শর্মা। মাতা স্বর্গীয় মানদা শর্মা। শিক্ষাজীবন শুরুশহরের ৪নং শাঁখারী বাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমানগমনের মধ্য দিয়ে। ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫৯ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে আই.এস.সি ও বি.এ পাশ করেন। ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রী নেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাষ্টার ডিগ্রী এবং পরবর্তীতে শিক্ষা বিষয়েও মাষ্টার ডিগ্রী অর্জন করেন।

ছাত্রজীব থেকেই তাঁর বিচিত্র পথে চলার এক দুরন্ত চেতন। আর তারই ধারাবাহিকতায় সঙ্গীত, ম্যাজিক, সার্কাসে তিনি বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। বিখ্যাত কমলা সার্কাস এর ওস্তাদ জালাল উদ্দিন ও নবী হোসেন মিঞা ম্যাজিসিয়ানের কাছে দীর্ঘদিন তালিম নেন। এই মানুষটির এডভেঞ্চার ও মনমানসিকতার কথা জেনে অবাক না হয়ে পারা যায় না যখন জানা যায় যে ননী গোপাল শর্মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় তদানিন্তন গোটা পূর্ব পাকিস্তানটাই বাই-সাইকেলে ভ্রমণ শেষ করেছিলেন! তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের সাইকেলে সারা দেশ ভ্রমণ করা প্রথম ব্যক্তি বলে পরিচিত।

ইতিহাসের বড় বড় নাম অর্থাৎ মহান কার্ল মার্কস-এঙ্গেলস, লালন, চিত্তরঞ্জন, ন্যালসন ম্যান্ডেলা, ড. আহম্মদ শরিফ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাত্মা গান্ধির মত মি. শর্মার কাছেও জাত-পাত বৈষম্য নির্বিশেষে মানবতাই একমাত্র ধর্ম। তিনি সব ধর্ম সম্পর্কেই ব্যাপক পড়াশোনা করেছেন। একজন মুসলমান হিসেবে আর একজন হিন্দু জনের কাছ থেকে শুদ্ধ উ”চারণে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত শোনে সঙ্গত কারনেই অন্তরে অন্তরে একটু পুলকিতই হয়েছিলাম। আই.সি.আই ইউনিভার্সিটি থেকে বেসিক বাইবেল স্টাডি কোর্স ও ইসকন থেকে গীতা স্টাডি কোর্সেও সনদ লাভ করেছেন।

আসলে একজন মানুষ যখন জাগতিক সংকীর্ণতা ও চিন্তার সীমাবদ্ধতা পেছনে ফেলে অন্যরকম উ”চতায় উঠে যায় তখন যেসব কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব হয় এই মানুষটিও ঠিক তেমনি একটি কাজ করেছেন। তা হলো মানব কল্যাণে বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে তাঁর মরনোত্তর মরদেহ দান করেছেন। তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি হাসি মুখেই বলেছিলেন, দেখো আমাকে পুড়ালে ছাঁই হবো, সমাহিত করলে পোকা মাকড় বা শিয়ালের খাবার হবো আর কফিনে পুড়লেও নাশ-ই হবো। তারচেয়ে বরং আমি মনে করি আমার এই দেহটা অথবা দেহের কোন না কোন অংশ যদি একজন বিপন্ন মানুষের কাজে লাগে তবেই আমি ধন্য।

জ্ঞান পিপাষু ননী গোপাল শর্মা নানামূখী কাজ করলেও শিক্ষকতাকে মনে প্রাণে ভালোবাসতেন। তাই কর্মজীবনের শুরুতে একটি কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার কাদিরপুর উ”চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি গণমানুষের সংগঠনের সাথেও নিজেকে আপন চেতন থেকে জড়িয়ে
ফেলেন। অষ্টগ্রাম উপজেলা কমিউনিষ্ট পার্টির সহ-সভাপতি পদে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি এবং ক্ষেতমজুর সমিতি করার অভিযোগে একাধিকবার চাকরিচ্যুত হলেও কর্মপাগল মানুষটি কোন দিন-ই হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। প্রয়োজনে টাকা ছাড়াই ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়িয়ে সময় কাটিয়েছেন।

বিশ্বাস-ই হয় না পঁচাত্তররোর্ধ বয়সেও তিনি লাইব্রেরীর নির্ধারিত সময় ছাড়া এলাকার শিশু-কিশোরদের একরকম বিনা বেতনেই ইংরেজী শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। আসলে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি বরাবরই বিলিয়ে গেছেন অর্জিত জ্ঞানের আলোর ছটা অকৃপণ হাতে; চালিয়ে গেছেন সমাজ কল্যাণমূলক কাজও।

বাজিতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি কমরেড ননী গোপাল শর্মা সম্পর্কে বাজিতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জালাল উদ্দিন জানান, সঠিক সেবার অভাবে তার এই অবস্থা । গত বছর ঠিক মতো খাবার না খেয়ে দুর্বল হয়ে পড়লে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি হন । আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে ভালো করে তুলি । আশা করি এবার ভালো হয়ে যাবে ।

বাজিতপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোরশেদা খাতুন লাইব্রেরীয়ান ননী গোপাল শর্মাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দেখতে যান । উন্নত চিকিৎসার জন্য ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল স্থানান্তরে করবেন বলে তিনি জানান ।