সৎকাজ, সে তো মুমিনের চিরসঙ্গী তবে,
আমর বিল মারূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। বরং, এ তো নবুওয়াতের উত্তরাধিকারতূল্য। কিন্তু আফসোস! ইবলীস মুসলমানদের অনেককেই ধোঁকায় ফেলে রাখে। তাদের কানে-কানে বলে যায়, বিশেষভাবে যিকর ধরো, নামায পড়ো, কিরাত পড়ো, রোযা রাখো, দুনিয়া-বিমুখ হও ইত্যাদি। অন্যেরা কি করল আর কি করল না, তা নিয়ে তোমার ভাবার দরকার নেই। আর তারা চোখ-কান বন্ধ করে নিরুদ্বিগ্ন সময় কাটাতে থাকে। আমর বিল মারূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটির কথা একেবারেই ভুলে যায়। যারা এরূপ করে তারা আম্মিয়াদের সত্যিকার ওয়ারিশের কাছে সবচেয়ে কম দীনদার। কেননা দীন হলো আল্লাহর নির্দেশ পালন করা। তাই বান্দার ওপর আরোপিত আল্লাহর হক আদায় করা থেকে যারা বিরত থাকে তারা তো গুনাহগার ব্যক্তির চাইতেও অধম। কেননা কোনো নির্দেশ অমান্য করার অপরাধ পাপকর্মে লিপ্ত হওয়ার চাইতে বেশি বড় অপরাধ।
এ অপরাধ আরো মারাতক হবে, যদি তরুণ উলামা সমাজ অথবা যুবশ্রেণী সমাজসংস্কারের পথ থেকে সরে গিয়ে নিজদেরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সমাজকে ছেড়ে দেয় দুষ্কৃতিকারীদের হাতে, অপসংস্কৃতির শিল্পী ও তারকাদের হাতে, ক্রীড়াঙ্গনের লোকদের হাতে, যারা তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকে সারাণ। আর আমরা বসে বসে অবস্থা দেখে কাঁদি আর বলি, ‘যামানা নষ্ট হয়ে গেছে। দিনকাল খারাপ হয়ে গেছে’। আমরা যামানাকে দোষ দিই। পান্তরে প্রকৃত দোষ তো আমাদেরই। কেননা আমরা নীরব, চুপচাপ বসে থাকি। পরিশেষে যখন অবস্থা নাগালের বাইরে চলে যায়, খারাবী ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে, তখন চমকে উঠি, অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতোই। আর তখন যা ভালো তা করতে নিষেধ করি, যা মন্দ তা করতে শুরু করি। সংস্কার ও ইসলাহের দায়িত্বে অবহেলা করার কারণেই আজ আমাদের এ অবস্থা।
এমন অনেক যুবককে দেখা যায়, যারা বেশভূষায় আল্লাহওয়ালা। কিন্তু তারা সমুদ্রের ফেনার মতো নিষ্ফল ও অকার্যকর। তাদের চোখের সামনেই একটার পর একটা অন্যায় কাজ সংঘটিত হয়, অথচ দাওয়াতের সকল সুযোগ তাদের সামনে উন্মুক্ত, সংস্কারের সকল মাধ্যম তাদের নাগালের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তারা অলস, গাফেল অবস্থায় বসে থাকে। হৃদয়ে কোনো হিম্মত খুঁজে পায় না। আল্লাহর দীনের হুরমত ও মর্যাদা বিনষ্ট হওয়ায় তাদের মধ্যে আদৌ কোনো ভাবান্তর সৃষ্টি হয় না, পরিবর্তন আসে না তাদের কার্যধারায়। এটা খুবই দুঃখজনক, আফসোসের বিষয়।
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম’
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, যে আল্লাহর নিষেধের প্রাচীরকে পদদলিত হতে দেখে, দীনকে পরিত্যক্ত হতে দেখে এবং তার রাসূলের সুন্নতকে বর্জিত হতে দেখে, এরপরও শীতল হৃদয়ে চুপচাপ বসে থাকে, সে তো বোবা শয়তান। যেমনিভাবে খারাব উক্তিকারী বাকপটু শয়তান।।
এরাই আল্লাহর গজবে নিপতিত হয়। এদেরকে পৃথিবীতে অনেক বড় বিপদে ফেলে রাখা হয়, অথচ তারা বুঝতেই পারে না। আর তা হলো অন্তরের মৃত্যু ঘটা। কারণ অন্তর জীবিত থাকলে তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিপে কোনো কিছু হলে তা রেগে উঠবে। দ্বীনের জন্য প্রতিশোধ স্পৃহায় টগবগ করে উঠবে। অথচ তা তো হয় না। তাহলে বুঝতে হবে তাদের অন্তরের মৃত্যু ঘটেছে।
আমাদের আশ-পাশে জানা-শোনার মধ্যে যেসব অন্যায় হয়, আমরা সেসবের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবো। হয়ত চুপ থাকার কারণে, নতুবা বাধা না দেয়ার কারণে। কিংবা এসব অন্যায় সংশোধনে প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহণ না করার কারণে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
(مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَراً فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيْمَانِ)
‘যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় হতে দেখে, সে যেন হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয়। তা সম্ভব না হলে জিহ্বা দিয়ে, তাও যদি সম্ভব না হয় তবে অন্তর দিয়ে, আর এটা হলো সর্বনিম্ন ঈমানী কর্তব্য’ (মুসলিম)।
হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, অন্যায় কাজে বাধা দেয়ার তিনটি পর্যায় রয়েছে।
১. হাত দিয়ে বাধা দেয়া বা সরাসরি হস্তপে করা।
২. কথার মাধ্যমে বাধা দেয়া বা মৌখিকভাবে নিষেধ করা।
৩. অন্তরে ঘৃণা করা এবং বাধা দেয়ার পরিকল্পনা করা।
যার যতটুকু মতা, সে ততটুকু প্রয়োগ করবে। তবে তাৎণিক বাধা দেয়াই মৌলিক কর্তব্য।
আল্লাহ তাআলা যখন মুমিনদেরকে নিরাপদ করে দেন। যখন তাদেরকে কোনো ভূখণ্ডে স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালনের সুযোগ করে দেন, তখন তারা যথার্থভাবে নামায আদায় করে, যাকাত দেয় এবং সৎকাজের আদেশ করে ও অসৎ কাজে বাধা দেয়। এটাই হল মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। আর এ বৈশিষ্ট্য থেকে যদি মুমিনরা সরে আসে, তাহলে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় আল্লাহ মুমিনদের ওপর থেকে তার নুসরত ও সাহায্য উঠিয়ে নেন, যতণ না তারা নতুন উদ্যমে দায়িত্ব পালনের শপথ নেয়।
আমর বিল মারূফ এর গুরুত্ব যেমন বেশি, তেমনি এর প্রতি অবহেলার কারণে সৃষ্ট বিপদের পরিমাণও বেশি। ফিতনা বেড়ে যাওয়া, সৎ-অসৎ নির্বিশেষে সকলের ওপর আযাব আসা, আল্লাহর দয়া ও সাহায্য থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং অন্যায়-অনাচার ও বিদ‘আতের সয়লাব হওয়া -ইত্যাদি সবই এর প্রতি অবহেলার ফলাফল।
সমাজে ছোট-বড় যত সমস্যা হয়, তার সিংহভাগই এ কাজ ছেড়ে দেয়ার কারণে হয়। ভেবে দেখুন, যদি সমাজের তরুণ ও যুবকরা নিজদেরকে এ কাজে জড়িত করত, যদি সমাজ সংশোধনে এগিয়ে আসত, সৎকাজের নির্দেশ দিত এবং অসৎকাজে বাধা দিত, তাহলে সমাজের অপরাধ কত শতাংশ কমে যেত।
‘আল্লাহর কসম! তোমরা যদি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা প্রদান না করো, তাহলে শীঘ্রই তোমাদের ওপর আল্লাহর আযাব আসার আশঙ্কা রয়েছে। তখন তোমরা দু‘আ করবে, কিন্তু তা কবুল হবে না’ (তিরমিযী)।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে যয়নব রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করে বলেছেন, ‘আযাব আসলে আমরাও কি ধ্বংস হব? অথচ আমাদের মধ্যে অনেক ভালো মানুষও আছে? রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ‘হ্যাঁ, যখন অন্যায় বেড়ে যাবে তখন সবাই ধ্বংস হবে’ (বুখারী ও মুসলিম)।
#সৎকাজে_আদেশ_করা
#অসৎকাজে_নিষেধ_করা
Информация по комментариям в разработке