Скачать или смотреть সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে মজহারীয় ধারণার পর্যালোচনা

ফরহাদ মজহারের স্ট্যটাসটি হুবহু উদ্ধৃত করছি:
"গতকাল যাঁরা চিন্তা পাঠচক্রে এসেছিলেন তাঁদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ফ্লোরা সরকারকে হাজার শুকরিয়া তিনি গতকালের পাঠচক্র সম্পর্কে চিন্তা পাঠচক্রের পাতায় দ্রুত একটি পোস্ট দিয়েছেন। আলোচনার সময় সবাইকে বোঝাবার জন্য আমরা নানা ভাবে হবস নিয়ে আলোচনা করেছি। যাতে মূল বইটি পড়তে আমাদের আগ্রহ বাড়ে। বিভিন্ন দিক থেকে আমরা 'লেভিয়াথান' আলোচনা করেছি। কিছু সারকথা মনে রাখলে আমাদের সম্মিলিত পাঠের গুরুত্ব আমরা ধরতে পারব।

‘লেভিয়াথান’-এ হবস আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি বিচার এবং কিভাবে তার বৈধতা নির্ণয় করা হয় সেই সকল দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রের পক্ষে যুক্তি হাজির করা, যাতে সমাজের দ্বন্দ্ব, বিরোধ এবং সমাজে বিরাজমান সতত গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়। আজ আমরা যে পরম পরাক্রমশালী ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্র দেখি, তাকে প্রয়োজনীয় ও ন্যায্য প্রমান করাই ছিল ‘লেভিয়াথান’এর উদ্দেশ্য। অথচ সমাজের উর্ধে দানবের মতো বসে থাকা এই ধরনের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই আজ জনগণকে লড়তে হচ্ছে এবং এমন সমাজের গঠনের কথা ভাবতে হচ্ছে যেখানে এই ধরনের দানব বা লেভিয়াথান-এর বিলয় ঘটবে, কোন দানব জনগণের টুঁটি টিপে ধরবে না। কিভাবে সেটা সম্ভব বুঝতে হলে পরম পরাক্রমশালী ও দানবের মতো সমাজের ওপর চেপে থাকা আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষে হবস যে যুক্তি দিয়েছেন তাকে প্রশ্ন ও মোকাবিলা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মানুষের প্রকৃতি বা স্বভাব সম্পর্কে দার্শনিক হবসের অনুমান ও ধারণা। চিন্তা পাঠচক্রে হবস পাঠ করার তাগিদ দানবীয় রাষ্ট্র মোকাবিলার সূত্র সন্ধানের জন্যই। এই ধরনের রাষ্ট্র পাশ্চাত্যে গড়ে উঠেছে।

'লেভিয়াথান' আদতে হিব্রু শব্দ। এটি একটি সামুদ্রিক দানব। এটি ইহুদি বিশ্বাসের অন্তর্গত এবং হিব্রু বাইবেলে Book of Job, Psalms, the Book of Isaiah, and the Book of Amos-এ 'লেভিয়াথান'-এর উল্লেখ আছে। হবস আধুনিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রের প্রতীক হিসাবে এটি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় আধুনিক রাষ্ট্র মূলত ইহুদি-খ্রিস্টিয় চিন্তারই ধারাবাহিকতা। এটি দাবি কতোটা সঠিক বুঝতে হলেও আমাদের 'লেভিয়াথান' পড়তে হবে। আধুনিক রাষ্ট্রের ইহুদি-খ্রিস্টিয় মর্ম বোঝার জন্য হবসের লেভিয়াথান পাঠ জরুরি হয়ে পড়েছে।

সরকার বা রাষ্ট্র না থাকলে সমাজের কী অবস্থা দাঁড়াতো, সেই অবস্থা সম্পর্কে কাল্পনিক অনুমান হবসের রাষ্ট্রতত্ত্বের ভিত্তি। একে হবস বলেছেন প্রাকৃতিক অবস্থা (state of nature)। এই ‘প্রাকৃতিক অবস্থায়’ প্রতিটি মানুষেরই যার যা ইচ্ছা বা যা খুশি তাই করার অধিকার থাকত। এর ফলে যে পরিস্থিতি দাঁড়াত তাকে হবস বলছেন,‘সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ’ (Bellum omnium contra omnes)। এই পরিস্থিতি এড়াবার জন্যই সামাজিক চুক্তি হিশাবে রাষ্ট্রের দরকার হয়ে পড়ে (বা, রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে) ; মানুষ তাদের যা খুশি তাই করার ‘স্বাধীনতা’ রাষ্ট্রের কাছে অর্পন করে এবং নিজেদের সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রের অধীনস্থতা মেনে নেয়। রাষ্ট্র সমাজের সদস্যদের ‘নিরাপত্তা’ দেয়। বর্তমানে আমরা র‍্যাব-পুলিশ আইনশৃংখলা বাহিনীর দাপটে অতীষ্ঠ যে নিরাপত্তামূলক রাষ্ট্র (সিকিউরিটি স্টেইট) দেখছি, তার দার্শনিক বা তাত্ত্বিক ভিত্তি জন হবসের ‘লেভিয়াথান’-এ প্রোথিত। এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়তে হলে মানুষের চরিত্র, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে যে সকল নির্বিচার অনুমান হবস করেছেন তাকে পর্যালোচনা ও নস্যাৎ করা দরকার। এই অনুমানগুলো আধুনিক রাষ্ট্র নিয়ে পাশ্চাত্যে যারা ভেবেছেন তাদের সকলের অনুমানের মধ্যেই রয়েছে। মার্কস, লেনিন কিম্বা মাও জে দং-ও এর বাইরে নন। ইসলামপন্থিরা যখন কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্রের গায়ে ইসলামি জোব্বা পরিয়ে ইসলামি রাষ্ট্র দাবি করে, তারা তখন মানুষের চরিত্র ও সমাজ সম্পর্কে হবসের অনুমানকেই মেনে নেন।

তাহলে আধুনিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়ানো হবসিয়ান অনুমানের পর্যালোচনা ছাড়া মানুষ, সমাজ এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ নতুন ভাবে বিচার করবার সুযোগ নাই বললেই চলে। এমনকি আধুনিক কালে এর বিপরীতে ইসলাম ‘সমাজ’ সম্পর্কে কোন নতুন প্রস্তাবনা দিয়েছি কিনা এবং তার তাৎপর্য কোথায় সেটা বুঝতে হলেও পাশ্চাত্য দার্শনিকদের চিন্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় দরকার। ইত্যাদি কারনে চিন্তা পাঠচক্রে হবস-এর ‘লেভিয়াথান’ পাঠ আমরা জরুরি মনে করেছি।

এ আলোচনা আমরা চালিয়ে যাব। এ বিষয়ে চিন্তা ওয়েব পাতায় লেখালিখির ওপর নজর রাখুন। আগ্রহীরা সব সময়ই স্বাগতম।"