আসলে আপনার প্রশ্নটির জবাব স্পর্শকাতর। এ প্রশ্ন উত্থাপন না করাই শ্রেয়। কেননা এটির উত্তর জানলে আমাদের ঈমান বাড়বে না। কিংবা না জানলে ঈমানের কোন ক্ষতি হবেনা। আখেরাতেও এ ব্যাপারে আমরা জিজ্ঞাসিত হব না। সুতরাং তাঁদের জান্নাত-জাহান্নাম বিষয়ে চিন্তা না করে নিজেদের জান্নাত-জাহান্নাম বিষয়ে বেশি বেশি চিন্তা করা উচিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مِنْ حُسْنِ إسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ অনর্থক অপ্রয়োজনীয় বিষয় ত্যাগ করাই একজন ব্যক্তির উত্তম ইসলাম। (তিরমিযী ২৩১৮, ইবনে মাজাহ ৩৯৭৬)
তাছাড়া পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি। (সূরা আহযাব ৫৭)
প্রশ্নকারী ভাই, একটু ভাবুন, রাসূল ﷺ পিতা-মাতাকে জাহান্নামী বললে তিনি কি খুশি হবেন? এতে কি তিনি কষ্ট পাবেন না? তাই এই অহেতুক আলোচনা না করাই নিরাপদ।
দুই- হয়ত শুনে থাকবেন, একদল আলেম বলেন, তারা উভয়ই জাহান্নামে যাবে, তাঁরা দলিল হিসাবে পেশ করেন-
১. আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল। আমার পিতা কোথায় আছেন (জান্নাতে না জাহান্নামে)? রাসূলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, فِي النَّارِ জাহান্নামে। বর্ণনাকারী বলেন, লোকটি যখন চলে যেতে লাগল, তিনি ডাকলেন এবং বললেন, إِنَّ أَبِي وَأَبَاكَ فِي النَّارِআমার পিতা এবং তোমার পিতা জাহান্নামে। (মুসলিম ২০৩ আবু দাউদ ৪০৯৫ মুসনাদে আহমাদ ১১৭৪৭)
২. আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
আমি আমার রবের কাছে আমার মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চেয়েছিলাম কিন্তু তিনি আমাকে অনুমতি দেন নি। আর তাঁর কাছে মায়ের কবর জিয়ারত করার অনুমতি চেয়েছিলাম তখন তিনি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন। (মুসলিম ৯৭৬)
তিন- উক্ত দলিল দুটির জবাবে ইমাম রাজী রহ. বলেন, ‘যারা জাহান্নামী হবার দাবি করেন। তাদের দলিল হলো মুসলিম, আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমাদের হাদিস। যাতে নবীজী ﷺ এর পিতা-মাতার জন্য নবীজী ﷺ -কে দোআ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ হাদিসের জবাব হলো, এটি রাসূল ﷺ বলেছেন তার পিতা-মাতার আসল অবস্থা সম্পর্কে তখন তিনি জানতেন না, তাই বলেছেন। আসলে তাঁরা জান্নাতী। (রদ্দুল মুহতার, মুরতাদ অধ্যায়-৪/২৩১)
তিনি আরও বলেন, প্রিয় নবী ﷺ এর মা-বাবা মুশরিক বা পৌত্তলিক ছিলেন না। তাঁরা এক আল্লাহকে বিশ্বাস করতেন এবং হযরত ইব্রাহিম আঃ-এর ধর্ম ‘হানিফ’ ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা মুর্তিপূজা করেছেন মর্মে কোন প্রমাণ নেই। তাঁদের নামও প্রমাণ করে তারা মুশরিক ছিলেন না। (প্রাগুক্ত)
ইবন হাজার হাইছামী রহ. বলেন, ‘আরবি ভাষায় أب (পিতা) শব্দ দ্বারা চাচাকেও বুঝানো হয়। সুতরাং হাদিসে যে ‘আমার পিতা’ বলা হয়েছে- এর দ্বারা উদ্দেশ্য চাচা আবু তালেব।’ (আলমানহুল মাক্কিয়্যা ১০২)
কতক মুহাদ্দিস বলেন, উক্ত হাদিসদ্বয় ‘খবরে অয়াহিদে’র অন্তর্ভুক্ত। আর এ শ্রেণীর হাদিস দ্বারা আকিদা-বিশ্বাস প্রমাণিত হয় না। সুতরাং এর ওপর নির্ভর করে রাসূল ﷺ পিতা-মাতাকে জাহান্নামী হিসাবে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।
মাসালিকুল হুনাফা ফি ওয়ালিদাইল মোস্তাফা ﷺ নামক গ্রন্থে জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহঃ বলেন, ‘আকাইদ ও উসুলবিদগণ এবং শাফেয়ী মাযহাবের ফোকাহাগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, দাওয়াত পৌঁছার পূর্বে যদি কেউ মুত্যুবরণ করে তাহলে সে নাজাতপ্রাপ্ত হবে। এটাকে বলা হয়, ফিতরাতের জামানা। রাসূল ﷺ পিতা-মাতা এই জামানায় ইন্তেকাল করেছেন। আর ফিতরাত সম্বন্ধে বিভিন্ন আয়াত ইঙ্গিত বহন করে যে তাদের কোন শাস্তি হবে না। যেমন এক আয়াতে রয়েছে, ما كنا معذبين حتى نبعث رسولا’কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।’ (সূরা বনি ইসরাইল ১৫)
সহিহ বুখারি (৪৩১৫)তে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ হুনাইন যুদ্ধে একটা পর্যায়ে বলেছিলেন, أنا النبى لا كذب أنا ابن عبد المطلب ‘আমি মিথ্যা নবী নই। আমি আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান।’ অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, وَأَذَانٌ مِّنَ اللّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الأَكْبَرِ أَنَّ اللّهَ بَرِيءٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ আর মহান হজ্বের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে লোকদের প্রতি ঘোষণা করে দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ মুশরেকদের থেকে দায়িত্ব মুক্ত এবং তাঁর রসূলও। (সূরা তাওবা ৩) যদি রাসূলুল্লাহ ﷺ মুশরিক-ঔরসে জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে তিনি নিজেকে এভাবে গর্বের সঙ্গে দাদা আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করতেন না। যেমন ইবরাহিম আঃ সম্পর্কে বলা হয়ছে, وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلاَّ عَن مَّوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لأوَّاهٌ حَلِيمٌ আর ইব্রাহীম কর্তৃক স্বীয় পিতার মাগফেরাত কামনা ছিল কেবল সেই প্রতিশ্রুতির কারণে, যা তিনি তার সাথে করেছিলেন। অতঃপর যখন তাঁর কাছে একথা প্রকাশ পেল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিলেন। নিঃসন্দেহে ইব্রাহীম ছিলেন বড় কোমল হৃদয়, সহনশীল। (সূরা তাওবা ১১৪)
মালেকী মাযহাবের একজন ইমাম কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবিকে জিজ্ঞাসা করা হল ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে যে বলে, নবী করিম ﷺ এর পিতা জাহান্নামী। তিনি জবাবে বললেন- من قال ذلك فهو ملعون ‘যে ব্যক্তি ইহা বলবে সে মালউন বা অভিশপ্ত। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি। (সূরা আহযাব ৫৭)’
তিনি বলেন, নবী করিম ﷺ এর পিতা জাহান্নামী এ কথা বলার চেয়ে অধিক কোন কষ্টদায়ক ব্যাপার নেই। (আদ্দুরাজুল মুনীফাহ ১০৩)
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহ. এ বিষয়ে আলাদা ৪টি পুস্তিকা লিখেছেন। ৯টি প্রবন্ধ লিখেছেন। যাতে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, রাসূল ﷺ-এর পিতা-মাতা জান্নাতী। জাহান্নামী নয়।
Информация по комментариям в разработке