Скачать или смотреть ১৯৭১ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ - আমার বাবার উপর আক্রমণ

১৯৭১ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ
আমার বাবার উপর আক্রমণ
আমাদের বাড়ি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার উলপুর গ্রামে । আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াতের বহু প্রাচীন রাস্তা ও নদীপথ। বর্তমানকালের বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যার উপর দিয়ে ঢাকা যাওয়া যায় ।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় এই রাস্তা পাকিস্তানের ফৌজদের একটি গুরুত্বপূর্ণ যাতায়াতের পথ ছিল । সৈন্যগণ প্রত্যেক স্টেশনের বিশিষ্ট নাগরিকদের গুলি করে মারা ,টাবুরে নৌকার মাঝিদের গুলি করে মারা ও তাদের নৌকাডুবি দেওয়া হত । এই মাঝির নৌকায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দরা গোপনে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে পাক- সেনার স্থানীয় গুপ্তচর তাদের সব খবর দিত ।
বাবা পাকসেনার পাকিস্তান বিরোধী মার্কামারা ধনী বনিক,পরগনার মাতব্বরি, গোপালগঞ্জের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মুকুটমণি । গোপালগঞ্জের সবচাইতে ধনী,সাহসী ও শক্তিশালী মহাজন । তিনি সব সম্প্রদায়ের বিশেষ করে মুসলমান ব্যবসায়ীদের পরামর্শদাতা ও তাদের অলিখিত ব্যাংক বললে অত্যুক্তি করা হবে না ।
পাকিস্তানবিরোধী রাজনৈতিক পার্টির শীর্ষ ও স্থানীয় নেতাদের নিরাপদ বাড়ি সেফ হাউস ছিল তার বাড়ি। সেখানে দিনেপালিয়ে থেকে রাতে বেরিয়ে যাওয়া গোপন ছিল না ।
প্রসিদ্ধ- নামকরা শ্রেষ্ঠ কয়েকদল ঢালী সেনা পরম্পরা অনুযায়ী তার হাতে।
বাবার সমাজের একটি গ্রাম ( গোপনীয়তার খাতিরে গ্রামের নাম লিখলাম না ) ছিল, সেই গ্রামে কেবলমাত্র সবরকম নৌকা ও ঘর গড়ার কাঠের মিস্ত্রী ছিল শুধু তা নয় তারা আগ্নেয় -অস্ত্রও বানাতে পারত ।

ছোটবেলা থেকে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা পর্যন্ত ওই গ্রামে আমাকে ছুটির সময় আমার আত্মীয় নিয়ে যেতেন । একদিন আমি ১৫/২০ টার মত একটি বন্দুকের আটি পুকুরের জলে লুকিয়ে রাখতে দেখেছিলাম । ওই বন্দুকের গোপনীয় কারখানা ও গ্রামের ওস্তাদগন বাবার আদেশ এবং তার টাকায় গড়ে তুলেছিল ।
পুলিশ- পালাশ এর সন্ধান পায়নি ; তবে গোয়েন্দা সৈন্য ও সাধারনণ পুলিশের ধারণা ছিল বিশ্বাস মহাশয় সব সময় আধুনিক জিনিসের পক্ষপাতী । কেবলমাত্র ঢাল সড়কি নিয়ে বসে থাকেনি ।
অতএব সে যে পাক সেনার গুলির নিশানা হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না । দিন এগিয়ে চলতে চলতে ব্যবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠলো । বাবা তার অতিনিকট অনুগতদের নিয়ে পরিকল্পনা করলেন আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপড়শিদের নিয়ে রাতের অন্ধকারে যশোর হয়ে ভারত রওনা হবেন।

যুদ্ধের সময় বাবার কয়েকটি নিরাপদ স্থান ঠিক করা ছিল । তার একটিতে যাওয়ার জন্য একজন মাঝি ও তার টাবুরে নাও ঠিক থাকতো ।
একদিন ভোরে যখন গুলির আওয়াজ বাবার কানে আসে, তখন তিনি দেরি না করে শীঘ্র সেই মাঝি ও তার টাবুরে নায় ছোট খাল দিয়ে নির্ধারিত নিরাপদ স্থানে যাওয়া শুরু করে । কিছুদূর এগোলে গুলির আওয়াজ বাড়তে থাকে । তখন বাবা জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে নৌকা থেকে নেমে পনেরো কুড়ি ফুট একটি খাড়ি চড়ে পাড়ে ওঠেন ও নিকটবর্তী একটি বড় সর্ষেক্ষেতের ভেতরে প্রবেশ করেন । সারাদিন ওই সর্ষের ডাংগার মধ্যে শুয়ে থাকেন । রাত্রে যখন সব শান্ত হয় তখন বাড়ি ফিরে আসেন।
হঠাৎ কিছু ঝপ করে জলে পড়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ায় বাবার আন্দাজ- ঝড়ুদা ফিরবার জন্য নৌকা ঘোরাবার সময় পাক সেনার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ।
বাবা তারপর তার আত্মীয়-স্বজন ও অন্যদের নিয়ে রওনা হলেন রাতের অন্ধকারে ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে । আরও কতজন- কে কোথায় গেল- ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল- কতনা মরল - বাঁচলো- কোন সঠিক হিসেব নেই ।
কিন্তু একথা বাস্তব যারা মরল তারা অধিকাংশ হিন্দু ।