সিরাহ- পর্ব-০৯ | আবিসিনায় প্রথম হিজরত মুসলিমদের | আর- রাহীকুল মাখতূম | অডিওবুকস বাই বুকব্যাংক
সিরাতের কোনো বই পড়া শুরু করতে চাইলে, নিঃশঙ্কচিত্তে ‘আর-রাহিকুল মাখতুম’ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। একে বলা যায়, সিরাতের বিশাল জগতে প্রবেশের একটি খোলা জানালা। ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জন, কুরআন অনুধাবন ও নিজের আত্মিক উন্নতি সাধনের জন্য নবিজি সম্পর্কে জানা সকলের জন্য আবশ্যক। একটি আদর্শ জীবনের নিখুঁত মানদণ্ড হলো শেষ নবি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহর ভাষায়⸺
ইহকাল ও পরকালে সকল সফলতা ও সৌভাগ্য কেবল রাসুলের পদাঙ্ক অনুসরণের মাঝেই নিহিত। তাই যে নিজের জীবনে কল্যাণ, সফলতা আর সৌভাগ্য কামনা করে, সে যেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাত চর্চা করে। এতে করে সে রাসুলকে চিনতে এবং সত্যিকার অনুসারী হতে পারবে। (যাদুল মাআদ- ১/৩৬)
বস্তুত নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুরো জীবনটাই ছিল কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। বিদগ্ধ লেখক আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরি রাহিমাহুল্লাহ সেই ছবিকে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে তুলে ধরেছেন বইটাতে। এতে প্রচুর তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহার ঘটেছে এবং অসংখ্য ঘটনার উপস্থিতি বইটিকে অনন্য মর্যাদায় উচ্চকিত করেছে।
বইটার ইউনিক দিক হচ্ছে, এর কাহিনির ধারা বিন্যাস। পর্যায়ক্রমে বইয়ের মধ্য ভাগে উঠে এসেছে দাওয়াতি কাজের লক্ষ্যে ইসলামের প্রচার-প্রসার, কুরাইশ কর্তৃক নানাবিধ জুলুম-নির্যাতন, ইসরা-মিরাজ, মুজিজা ও হিজরতের আখ্যান। মুসলিমদের দাওয়াতি কার্যক্রম ও সামরিক তৎপরতা নিয়ে বিস্তর আলোকপাত করা হয় স্বতন্ত্র অধ্যায়ে। তুলে ধরা হয় নবিজির রাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধনীতি, সন্ধি-চুক্তি এবং রক্তস্নাত বদর, ওহুদ ও খন্দকসহ অন্যান্য যুদ্ধের জ্বলন্ত ইতিহাস। বইয়ের শেষ ধাপে মক্কা বিজয়, বিদায় হজসহ নবি জীবনের অন্তিম সময়টাকে নিখুঁত শব্দমালায় চিত্রায়ণ করা হয়। আলোকপাত করা হয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবার-পরিজন এবং তার শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও চারিত্রিক গুণাবলি নিয়ে।
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন যেন এক বৃহৎ শিক্ষায়তন। জ্ঞানের গভীর উৎস। অন্তহীন বয়ে চলা শীতল ফল্গুধারা। একটি সাদামাটা জীবনের প্রতিচ্ছবি। বইটাতে প্রকাশ পেয়েছে তার দ্যুতিময় ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা। পাশাপাশি উঠে এসেছে, ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সাহাবিদের অবিস্মরণীয় ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা। আমৃত্যু ইসলামের জন্য লড়ে যাওয়ার প্রত্যয় দৃশ্যমান হতো তাদের চোখে-মুখে। তাদের কষ্টে ভরা জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতির দাগকে অম্লান করে রাখা হয়েছে সাদা পাতায়।
ঘটনা বর্ণনার পাশাপাশি লেখকের বিশ্লেষণ দক্ষতা স্রেফ মুগ্ধ করেছে আমাকে। তথ্যের বিশুদ্ধতা এবং চমৎকার বর্ণনাশৈলীর ফলে, বইটি প্রথমবার পড়লেই, সিরাতের একজন নবীন পাঠকেরও জানা হয়ে যাবে অনেককিছু। আরও জানা যাবে কিছু আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট ও তাফসির। প্রয়োজনানুসারে কয়েক জায়গায় মানচিত্র যুক্ত করা হয়েছে; এতেকরে পাঠসূচি বুঝতে সহজ হয়। মহাকালের মহান ব্যক্তিত্ব রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অধিক বিবাহের প্রসঙ্গ নিয়ে লেখক অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। এর ফলে, নবিজির বিবাহ-সংক্রান্ত বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুরো জীবনী কেবল একটি বই পড়লেই জানা হয়ে যাবে না। অনেক পাঠক, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ধারণা, ‘আর-রাহিকুল মাখতুম’ এ নবি জীবনের সার্বিক দিক উঠে এসেছে। ফলে, এই বইটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাদের সিরাত যাত্রা। প্রকৃতপক্ষে, সামান্য কয়েক পাতায় নবিজির ৬৩ বছরের জীবনটাকে কখনোই তুলে আনা সম্ভব নয়। বস্তুত সিরাতের ঘটনারাজি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন গ্রন্থে। তাই পাঠকমনে সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের পরিপূর্ণ অবয়ব ফুটিয়ে তুলতে চাইলে, অধ্যয়ন করতে হবে একাধিক বই। আবার একনাগাড়ে শুধু পড়ে গেলেই হবে না, থাকতে হবে তার মতো জীবন গড়ার স্পৃহা। ‘আর-রাহিকুল মাখতুম’ পাঠককে আকৃষ্ট করে, নবিজীবনকে আরও বিস্তৃতভাবে খুঁটে খুঁটে দেখতে। মূলত, এখানেই গ্রন্থকার সার্থক। এটিই বইটার বৈশিষ্ট্য।
উহুদ যুদ্ধের বিষয়ে বিস্তারিত না জেনেই, অনেকে এর ফলাফল হিসেবে মুসলিমদের পরাজয় বলে গণ্য করে থাকে। এটা একপ্রকার ভুল বৈ আর কিছু নয়। বাস্তবতা হলো, তৎকালীন সময়ে একটি যুদ্ধে নিজেদের জয়ী ঘোষণা করতে হলে, বিজয়ী দলের বেশকিছু নিদর্শন থাকতে হতো।
✲ শত্রু শিবির দখল করা।
✲ যুদ্ধ শেষে ময়দানে তিন দিন অবস্থান।
✲ যুদ্ধবন্দি বা গনিমত লাভ ইত্যাদি।
কুরাইশরা যার কোনোটিই করতে সক্ষম হয়নি। উলটো তারা নিজেরাই আগেভাগে ধরেছিল মক্কার পথ। অথচ মুসলিমরা তখনও রণাঙ্গন ত্যাগ করেনি। তবে এ কথা সত্য যে, তুমুল লড়াইয়ের ফলে দু-দলই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল অমীমাংসিত যুদ্ধ। বিষয়টি দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন লেখক।
মক্কা বিজয়ের প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে বইটিতে। দিগ্বিজয়ী সামরিক শক্তি বা বৃহৎ কোনো জনগোষ্ঠীর সমর্থনে ইসলামের বিজয় অর্জিত হয়নি; সাফল্য এসেছে কেবলই আল্লাহর সাহায্যে। মুসলিম মানসে এই চেতনাবোধটুকু জাগিয়ে তোলার জন্য⸺লেখক কলম চালিয়েছেন শান্ত গতিতে। আফসোস, মুসলিমদের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলি এখন কেবলই অতীতের ফ্রেমে বাঁধা। চলমান সংকট মোকাবেলায় মুসলিম উম্মাহর উচিত, একনিষ্ঠভাবে সালাফদের পথ অনুসরণ করা। নব্য আবিষ্কৃত পথ বা পদ্ধতি ইসলামকে শুধু পেছন দিকেই টেনে রাখবে।
এ এক অদৃশ্য সুতোর টান।
নবিপ্রেমের এমন মুগ্ধকর অমৃত স্বাদ ও তীব্র অনুভূতি সৃষ্টিকারী বলেই সিরাত প্রেমীদের পাঠস্মৃতিতে সবসময় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকে ‘আর-রাহিকুল মাখতুম’। মনে গেঁথে যায় দ্বীন ইসলামের বিশুদ্ধ চিন্তাধারা। হৃদয় চিড়ে বয়ে যায় প্রিয়তম রাসুলের প্রতি স্নিগ্ধ অনুরক্তির ঝরঝর নির্ঝরণী।
একঝলকে শেষ নবি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনদর্শন জানতে ও বুঝতে হলে, সমকালীনের ‘আর-রাহিকুল মাখতুম’ (মোহরাঙ্কিত সুধাময় জীবন) সবার পাঠ্য হওয়া উচিত।
Информация по комментариям в разработке