আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
আজ আমরা যে আলোচনায় প্রবেশ করব, তা মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত একটি বিষয় সেটা হলো —স্রষ্টার প্রমাণ।
আমি চেষ্টা করব এখানে ভিন্নধর্মী, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক যুক্তি উপস্থাপন করে যেন আমরা নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত অবিরাম বিতর্ক চলে আসছে। এই বিতর্কের মূল ক্ষেত্রগুলো আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি—দার্শনিক যুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তি।
🔹 দার্শনিক যুক্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
Cosmological Argument – মহাবিশ্বের প্রথম কারণ তত্ত্ব।
Design Argument – জটিলতায় নকশার প্রমাণ।
Ontological Argument – অস্তিত্বতত্ত্বভিত্তিক প্রমাণ।
Moral Argument – নৈতিকতার ভিত্তি।
Religious/Existential Argument – ধর্মীয় ও অস্তিত্ববাদী অভিজ্ঞতা।
🔹 বৈজ্ঞানিক যুক্তির মধ্যে রয়েছে:
Big Bang and universe – মহাবিশ্বের সূচনা।
Fine-Tuning of the Universe – সূক্ষ্মভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ মহাবিশ্ব।
Complexity of life – জীবনের জটিলতা।
The Hard Problem of Consciousness – চেতনার রহস্য।
Mathematics and natural law – গণিত ও প্রাকৃতিক নিয়ম।
এখন আসুন, আমরা প্রচলিত এই যুক্তিগুলোর বাইরেও একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করি—যা সবার চিন্তার খোরাক জোগাবে।
ধর্ম ভীরু মানুষের নিকট যৌক্তিক বিশ্বাসেই যথেষ্ট, কিন্তু নাস্তিক বা সংশয়বাদীরা যৌক্তিক বিশ্বাসে সন্তুষ্ট নয়, তারা সরাসরি বৈজ্ঞানিক বা গাণিতিক প্রমাণ দাবি করেন।
ধার্মীক ও নাস্তিকদের মধ্যে বিজ্ঞানের সাহায্যে এখানে একটি সেতু রচনা করা সম্ভব এই অসীমতা বা ইনফিনিটির ধারণা দিয়ে।
👉 বলা হয়, সৃষ্টিকর্তা অসীম শক্তির অধিকারী। আবার, আধুনিক গণিত ও বিজ্ঞানের ভিত্তিও দাঁড়িয়ে আছে এই ইনফিনিটির উপর। ক্যালকুলাস থেকে শুরু করে পদার্থবিদ্যার জটিলতম সমীকরণ পর্যন্ত সর্বত্র অসীম ও infinitesimal এর ব্যবহার রয়েছে।
অর্থাৎ, স্রষ্টার ধারণা এবং আধুনিক বিজ্ঞান উভয়ই এই অসীমতা ছাড়া অচল। তবে আমি বলছি না যে, ইনফিনিটিই সৃষ্টিকর্তা, বরং ইনফিনিটি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার শক্তির এক মাত্রা মাত্র।
এখন আসুন ইনফিনিটি ও স্রষ্টার সাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা করি:
১. স্রষ্টা ও ইনফিনিটি অদৃশ্য অথচ অপরিহার্য:
গণিতে ইনফিনিটি সরাসরি কোনো বাস্তব সংখ্যা নয়। আমরা তাকে ছুঁতে বা মাপতে পারি না, কিন্তু সীমা (limit), ইন্টিগ্রেশন ও ধারার (series) মাধ্যমে তার কার্যকারিতা ছাড়া গণিত এগোয় না।
ঈশ্বরতত্ত্বও তেমন—তাঁকে আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে সরাসরি পাওয়া যায় না, কিন্তু তাঁর ধারণা ছাড়া নৈতিকতা, মহাবিশ্বের প্রথম কারণ কিংবা মানব জীবনের অর্থ—সবই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তবে, নবী-রাসূলগণ ও আল্লাহর অলীদের বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল যা সাধারণ মানুষের উপলব্ধির বাইরে।
২.স্রষ্টা ও ইনফিনিটির অপরিহার্যতা (Necessity):
ইনফিনিটি বাদ দিলে বহু গণিতীয় সূত্র অকার্যকর হয়ে পড়ে।
একইভাবে, স্রষ্টার ধারণা বাদ দিলে মানবজীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলো—“কেন অস্তিত্ব?”, “কেন শৃঙ্খলা?”—উত্তরহীন থেকে যায়।
৩. স্রষ্টা ও ইনফিনিটির পরোক্ষ অভিজ্ঞতা:
আমরা ইনফিনিটিকে সরাসরি দেখি না, কিন্তু তার প্রভাব সীমা ও অসীম ধারা দিয়ে উপলব্ধি করি।
ঈশ্বরকেও সরাসরি পাওয়া যায় না, তবে তাঁর প্রভাব আমরা দেখি নৈতিক চেতনায়, মহাবিশ্বের সূক্ষ্ম নকশায় এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতায়।
নাস্তিক বা অবিশ্বাসীরা এই সাদৃশ্যের বিপক্ষ যুক্তিও দিয়ে থাকেন, এখন আমি এগুলো ধাপে ধাপে খণ্ডন করছিঃ
বিপক্ষের যুক্তি ১: “ইনফিনিটি একটি গাণিতিক ধারণা, ঈশ্বর কেবল বিশ্বাসের বিষয়।”
👉 যুক্তি খণ্ডনঃ
ইনফিনিটি যেমন গণিতের জন্য অপরিহার্য, তেমনি স্রষ্টার ধারণা প্রায় সব সভ্যতার চিন্তায় অপরিহার্য হয়ে এসেছে। উভয়ই মানুষের বোধগম্যতার বাইরে হলেও চিন্তার কাঠামোয় অপরিহার্য।
বিপক্ষের যুক্তি ২: “ইনফিনিটিকে ব্যবহার করা যায়, ঈশ্বরকে যায় না।”
👉 যুক্তি খণ্ডনঃ ইনফিনিটিকে সরাসরি মাপা যায় না, কেবল প্রভাবের মাধ্যমে বোঝা যায়। একইভাবে ঈশ্বরকেও সরাসরি পরীক্ষা করা যায় না, তবে মহাবিশ্বের নিয়ম, জীবনের সূক্ষ্ম সমন্বয় ও নৈতিকতার অস্তিত্বে তাঁর প্রভাব স্পষ্ট।
বিপক্ষের যুক্তি ৩: “ইনফিনিটি বাস্তব নয়, ঈশ্বর বাস্তব।”
👉 যুক্তি খণ্ডনঃ ইনফিনিটি বাস্তবে ধরা না গেলেও বাস্তব সমস্যার সমাধানে অপরিহার্য। ঈশ্বরও তেমনি দৃশ্যমান নন, কিন্তু তাঁর ধারণা ছাড়া মহাবিশ্বের উৎপত্তি বা জীবনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা অসম্ভব।
বিপক্ষের যুক্তি ৪: “ইনফিনিটি তত্ত্বগত প্রয়োজন, ঈশ্বর বিশ্বাসগত প্রয়োজন।”
👉 যুক্তি খণ্ডনঃ তত্ত্ব ও বিশ্বাস সম্পূর্ণ আলাদা নয়। শূন্য (০) এক সময় কেবল ধারণা ছিল, পরে গণিতে অপরিহার্য সত্যে রূপ নেয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বহু ধারণাও প্রথমে অনুমান ছিল, পরে পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়েছে। একই ভাবে ঈশ্বরের ধারণাও বিশ্বাসের পাশাপাশি দর্শন ও বিজ্ঞানে এক অপরিহার্য তত্ত্বে রূপ নিতে পারে।
সারসংক্ষেপ
🔹 উভয়ই—ইনফিনিটি ও স্রষ্টা—সরাসরি ধরা যায় না।
🔹 উভয়কেই আমরা পরোক্ষ প্রভাবের মাধ্যমে উপলব্ধি করি।
🔹 উভয়ই জগৎ ও চিন্তার কাঠামোয় অপরিহার্য।
তাহলে দেখা যায়, উপমাটি ভেঙে যায় না, বরং আরও শক্তিশালী হয়।
উপসংহার
প্রথমত, ঈশ্বর দর্শনে সংজ্ঞায়িত—তিনি “প্রথম কারণ”, “অপরিহার্য সত্তা”।
দ্বিতীয়ত, ইনফিনিটি সরাসরি ধরা না গেলেও তার প্রভাব স্পষ্ট; ঈশ্বরও তেমনি মহাবিশ্বে প্রভাব বিস্তার করেন।
তৃতীয়ত, ইনফিনিটি বাস্তবে না থাকলেও বাস্তব সমস্যার সমাধানে অপরিহার্য; ঈশ্বরও তেমনি জীবনের মৌলিক প্রশ্নে অপরিহার্য।
চতুর্থত, শূন্য যেমন ধারণা থেকে সত্যে রূপ নেয়, ঈশ্বরের ধারণাও বিশ্বাস থেকে যুক্তি ও দর্শনে দৃঢ় ভিত্তি পেতে পারে।
অতএব বলা যায়—
“স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ অনেকটা গণিতের ইনফিনিটির অস্তিত্বের মতোই—অদৃশ্য অথচ অপরিহার্য।”
ধন্যবাদ। 🙏
Please Subscribe our Channel
Информация по комментариям в разработке