গবেষণামূলক টীকা
রামকিঙ্কর বেইজের (১৯০৬ – ১৯৮০) শেষ বয়সের প্রিয় গানটি তাঁর প্রয়াণের পরে কলাভবনের স্মৃতিসভায় খালি গলায় গেয়েছিলেন মোহরদি। 
‘রক্তকরবী’ নাটকের আটটি গানের মধ্যে প্রেমপর্যায়ের আলোচ্য গানটির স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (স্বরবিতান ১, ১৯৩৫)। স্বরবিতানে রাগ ও তালের উল্লেখ না থাকলেও স্বরলিপির চলন দেখে বোঝা যায় এটি কাহারবা তালে নিবদ্ধ। সুধীর চন্দের মতেও তাই (‘রবীন্দ্রসঙ্গীতে রাগসুর নির্দেশিকা’)। প্রকাশিত রেকর্ডের ধারাবাহিকতা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে কাহারবা তালে নিবদ্ধ কোনো রেকর্ড পাইনি। কবি জীবিতকালে নাটকটি মঞ্চস্থ করার চেষ্টা করেও সফল হননি। কারোর একক কণ্ঠে গানটি শুনেছিলেন কিনা, সেই তথ্যও নেই। তালনিবদ্ধ স্বরলিপিটি তাঁর জীবিতকালে প্রকাশিত হওয়ায় ধরে নিতে হবে যে এটি তালেই গেয়ে দিনেন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন। 
বিস্ময়করভাবে, এটির মুক্তছন্দে গায়নের ঐতিহ্য থেকে রবীন্দ্রপরবর্তী রবীন্দ্রসঙ্গীতগায়নের স্বপ্রণোদিত স্বাধীনতা ব্যবহারের বিশৃঙ্খলা ধরা পড়ে। 
অবশ্য ১৯৩৪ সালে একটি ভিন্ন সংস্থা এটি কলকাতায় মঞ্চস্থ করেছিল, যেখানে কবি উপস্থিত ছিলেন। গানটি কীভাবে গাওয়া হয়েছিল জানা নেই। 
স্বরলিপির সুর ও রেকর্ডের সুর
যতদূর পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি, রেকর্ডগুলির সুরে টপ্পার কাজ আছে, যা স্বরলিপিতে নেই।  মায়া সেন ২০০৯ সালের এপ্রিল-মে মাসে মুক্তছন্দে গানটি শিখিয়েছিলেন খুব কম এবং ছোট ছোট টপ্পার কাজসহ। এই ক্লাস রেকর্ড ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে (    • In Maya Di’s Class: Part XI/ O Chand Chokh...   )। তাঁর শিখনে ‘ও’ কথাটিকে স্বরলিপির মতোই গাওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থায়ী অংশের শেষে ‘ও চাঁদ’-এর ‘ও’ কথাটিতে মধ্যমে দুটি টপ্পার কাজ দেওয়া হয়েছে, যেটি নিম্নরূপ - 
ন্সা  – রজ্ঞা    মজ্ঞমজ্ঞা   -জ্ঞা
ও০      ০  ০     ০ ০  ০ ০      ০ 
গানটির সৃষ্টি
গ্রীষ্মাবকাশে কবি শিলংযাত্রা করেন ২৬/০৪/১৯২৩এ এবং সেখান থেকে অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা পত্রে (২৮ বৈশাখ ১৩৩০, ১৯২৩) নাটকটি লেখার কথা জানান। এর মোট এগারোটি খসড়ার মধ্যে তিনটি লেখা হয় শিলংয়ে। নটি রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত। সবগুলিই বিভিন্ন পরিবর্তনের সাক্ষী, কিন্তু বিশুপাগল ও তার দ্বারা গীত আলোচ্য গানটি প্রথম খসড়াতেই আবির্ভূত হয় এবং কবির জীবৎকালে প্রকাশিত একমাত্র সংস্করণে (২৭/১২/২৬) তা বজায় থাকে। এটিই চূড়ান্ত পাঠ। অবশ্য বিবিধ খসড়ায় গানটির পাঠান্তর ঘটেছে। 
গানটি লেখার নির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া সম্ভব নয়। ১৩৩১এর আশ্বিন মাসে (১৯২৪) ‘প্রবাসী’তে ‘রক্তকরবী’ নামে প্রথম প্রকাশিত হয়। এটিকেই আলোচ্য গানটির লেখার সময়কাল ধরে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে বলে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় মনে করেন (‘গীতবিতান – কালানুক্রমিক সূচী’)। এই বছরই ‘Visva Bharati Quarterlyতে নাটকটির ইংরাজি অনুবাদ তথা গানটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়
(I lament heaves and bursts)।
তত্ত্ব ও দর্শনঃ বিশুপাগল, নন্দিনী ও আলোচ্য গান
নন্দিনীর উদ্দেশ্যে বিশুপাগল কর্তৃক গীত গানটির অর্থের ব্যাখ্যার প্রাথমিক উৎস তিনটিঃ 
ক। কবিকর্তৃক ইংরাজিতে লিখিত নাটকটির ব্যাখ্যা (Visva Bharati Quarterly, ১৯২৫)। 
খ। মুদ্রিত নাটকে কবিকর্তৃক লিখিত ‘প্রস্তাবনা’ ও ‘নাট্যপরিচয়’ (১৯২৬)।
গ। এল্মহার্স্টকর্তৃক লিখিত ব্যাখা (Visva Bharati Quarterly, ১৯৫১)।
এই প্রাজ্ঞ ব্যাখ্যাগুলির বাস্তব অর্থ হচ্ছে শিল্পবিপ্লবোত্তর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ক্ষমতার কাছে মানবাত্মার পরাজয়, যেখানে ‘ধানের শিষে শিশির লেগে’ ‘আলোর খুশি জেগে ওঠে না’।  
এই জেগে না ওঠার প্রতিবাদের দ্যুতি হিসাবে নন্দিনীর আবির্ভাব। আলোচ্য গানের ঠিক পূর্বে বিশুপাগলের অপর একটি গানের ভাষায় নন্দিনী হল ‘ঘুমভাঙানিয়া’ ও ‘দুখজাগানিয়া’।  এইভাবে সমগ্র নাটকটির নির্যাসে আলোচ্য গানটিকে জারিত করে না বুঝলে সঠিক গায়কী তৈরি করা যায় না। 
মানবাত্মার এই চোখের জলের জোয়ারের একটি বাস্তব রূপ এখানে পাওয়া যায়। বিশুকে বেঁধে নিয়ে যেতে দেখে, মানুষ মানুষের উপর কীভাবে এই লজ্জাহীন আচরণ করে – সেই প্রশ্ন নন্দিনীর উক্তিতে উত্থিত হয়েছে। এটি পশ্চিমী ন্যায়ব্যবস্থা সম্বন্ধে কবির দৃষ্টিভঙ্গী। 
গানটির মধ্য দিয়ে বিশু ও নন্দিনী তথা নারী ও পুরুষের প্রকৃতিদত্ত মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানটি পরিস্ফুট করতে হয়েছে কবিকে। সেটি পরিবার ও যৌনতার ঊর্ধ্বে তৃতীয় এক সৌন্দর্যের পরিসর (‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি’, রচনাবলী ১২, পৃষ্ঠা ২২০-২১, পঃবঃ সরকার)। কবির আজীবনের সৃষ্টির সেটি একটি উৎস। 
আলোচ্য গান ও নাটকের বক্তব্যের প্রস্তুতি তৃতীয় আমেরিকা সফরে সুস্পষ্ট হয়ে যায়। সেখান থেকে অ্যান্ড্রুজকে লেখেন (১৪/০১/১৯২১) যে যন্ত্র ও দেশপ্রেম মানবব্যক্তিত্বকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে (রবিজীবনী, নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭, প্রশান্তকুমার পাল)। দেশে ফিরে মার্কিন সমাজ সম্বন্ধে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে গান লেখেন (২৪/১১/১৯২১) ‘সময় কারো যে নাই…গান হায় ডুবে যায় কোন কোলাহলে’ (গীতা ঘটক,    • Samoy Karo Je Nai(সময় কারো যে নাই)-Geeta G...   ), ( সময় কারো-যে নাই, আশীষ লাহিড়ী, একক মাত্রা, পঞ্চদশ বর্ষ, জুলাই, ২০১৪)। 
১৯২৩এর আগস্ট মাসে ‘বিসর্জন’ নাটকের জন্য লেখেন ‘আঁধার রাতে একলা পাগল’ (রুনা মজুমদার,    • Tagorean Song in Muktochhondo/ Andhar Rate...   )। এর সঙ্গে বিশুপাগল ও আলোচ্য গানের দূরত্ব নেই। ‘পাগল’ প্রবন্ধে কবি দেখান যে ‘যাহার তার ছিঁড়িয়া যায়, সে হয় উন্মাদ, আর যাহার তার অশ্রুতপূর্ব সুরে বাজিয়া উঠে, সে হইল প্রতিভাবান।‘ (রবিজীবনী, প্রশান্তকুমার পাল, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ১৮২)।
শেষ কথা
শম্ভু মিত্র পরিচালিত বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’ ও ‘মুক্তধারা’ নাটকে সমস্ত গান পরিত্যক্ত হয়েছে। শঙ্খ ঘোষ (‘কালের যাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক’) এবং সুধীর চক্রবর্তী (‘গানের লীলার সেই কিনারে’) মনে করেন রবীন্দ্রনাটকে গান প্রক্ষিপ্ত, নাটককে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে না। নাট্যশাস্ত্রের দিক থেকে যদি আমরা বিষয়টিকে বিচার নাও করি, তবুও বলা যায় তাঁদের আলোচনায় ব্রহ্মচর্যাশ্রম ও পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাস্তব চাহিদাটি বিবেচিত হয়নি। 
No infringement of copyright is intended.
                         
                    
Информация по комментариям в разработке