গবেষণামূলক টীকাঃ
গানটি একই রেকর্ডে দুবার গাওয়া হয়েছে একতাল ও মুক্তছন্দে।
পূজা পর্যায়ে রামকেলী রাগে একতালে নিবদ্ধ খেয়ালাঙ্গের গানটি ১৯১৫ সালে তালবাদ্য সহকারে রেকর্ড করেন আচার্য রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী (১৮৫২-১৯২৫), ( • Swapan jodi bhangile rajani probhate - Rad... )। পরবর্তী ১১০ বছরে কোনো অজ্ঞাত কারণে এটি মুক্তছন্দে গাওয়া হয়েছে। বর্তমান রেকর্ড দ্বিতীয়, যা তালবাদ্য সহকারে গীত হচ্ছে। অবশ্য রাজেশ্বরী দত্ত অনুষ্ঠানে তালবাদ্য সহকারে গানটি গেয়েছেন, যা স্টুডিও রেকর্ডিং নয় ( • Swapan Jodi Bhangile Rajaniprobhate (Live ... )।
গানটি লেখার তারিখ অজ্ঞাত। মাঘোৎসবে (১৩০৯, ১৯০৩) সকাল ও সন্ধ্যায় যে তেইশটি ব্রহ্মসঙ্গীত গীত হয়, তার মধ্যে সকালের উপাসনায় গানটি ছিল। পরের মাসে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মূল পাণ্ডুলিপি আছে ‘মজুমদার পুঁথিতে’, যা রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত।
গড়ে ওঠার জটিলতাঃ
মাঘোৎসবে গাওয়ার সময়ে এটির স্বরক্ষেপণ কেমন ছিল, কোনো স্বরলিপি প্রণিত হয়েছিল কিনা, গানটি কে কখন কবির কাছে শিখেছিলেন – এসব তথ্য নেই। উক্ত মাঘোৎসবের বারো বছর পরে রাধিকাপ্রসাদের রেকর্ড যখন প্রকাশিত হল, তখন আদি সুরের সঙ্গে তার পার্থক্য কতদূর অথবা কোনো পার্থক্য ছিল কিনা, এসব আমরা জানি না। তিনি কি উক্ত মাঘোৎসবে গানটি শুনে তুলে নিয়েছিলেন না কবি তাঁকে শিখিয়েছিলেন, সেই তথ্য অজ্ঞাত। ব্রহ্মসঙ্গীতের সঙ্গে রাধিকাপ্রসাদের পরিচয় যে বহু পুরোনো, তার প্রমাণ হিসাবে বলা যায়, শান্তিনিকেতনের পৌষ উৎসবে (১৩০৯, ১৯০২) তিনি ও আদি ব্রাহ্মসমাজের গায়ক কাঙ্গালীচরণ সেন, ত্রৈলোক্য সান্যাল এবং জগদীশচন্দ্র বসু উপস্থিত ছিলেন।
রাধিকাপ্রসাদের রেকর্ড অনুসারে একতালে স্বরলিপি করেন সঙ্গীতভবনের অধ্যাপক ভি ভি ওয়াজ়েলওয়ার। রবীন্দ্রসঙ্গীতের কয়েক প্রজন্মের গুরুরা তাঁর শিষ্য। রাধিকাপ্রসাদ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতশিল্পী হিসাবে তাঁর রেকর্ডে তান ব্যবহার করলেও স্বরলিপিতে তা বর্জন করা হয় (স্বরবিতান ৬৩, ১৩৯০)।
এই গানে রাধিকাপ্রসাদের গায়কী রবীন্দ্রানুগ নয়। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিটকিরিসহ আলোচ্য গানটি রাধিকাপ্রসাদ কবিকে শোনাচ্ছেন, সেই কথা ’স্মৃতির খেয়া’ গ্রন্থে সাহানা দেবী জানিয়েছেন (পৃ ১৪৮)।
গানটি মাঘোৎসবে প্রথম গীত হওয়ার নব্বই বছর পরে কেন স্বরলিপি প্রকাশিত হল, তা বিস্ময়কর। উক্ত রেকর্ড নিশ্চিতভাবে রবীন্দ্রনাথ শুনেছিলেন। এটি কবির অনুমোদিত ইম্প্রোভাইজ়েশন কিনা, সেই প্রশ্ন ওঠে। পণ্ডিত ওয়াজ়েলওয়ার শান্তিনিকেতনে কবির কণ্ঠে গানটি শুনেছিলেন বা শিখেছিলেন কিনা, সেই তথ্য নেই। তবে যেভাবে তালে স্বরলিপি প্রণিত হয়েছে, শান্তিনিকেতনে বহুকাল হয়তো সেইভাবেই গাওয়া হয়েছে। তিনি আমাদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে আসতেন, কিন্তু এসব প্রশ্ন করার মতো পড়াশোনা ছিল না। উল্লেখ্য যে শ্রী কানাই সামন্তের প্রশ্নের উত্তরে (১৮/০১/৭৩) প্রফুল্লকূমার দাস জানান যে ওয়াজ়েলওয়ারের তৈরি করা স্বরলিপি রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু কবে এই স্বরলিপি প্রণিত হয় বা প্রকাশিত হয়নি কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি দেননি। উল্লেখ্য যে গীতবিতানকে আমরা এখন যে রূপে পাই, তা এর দ্বিতীয় সংস্করণ। এর প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ এবং তৃতীয় খণ্ড সম্পাদনা করেন শ্রী কানাই সামন্ত।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী গানটির একটি স্বরলিপি করেছিলেন (’গীতবিতানঃ কালানুক্রমিক সূচী)। কিন্তু এই তথ্যের উৎস কী অথবা স্বরলিপিটি কোথায় জানা নেই। এককথায় রবীন্দ্রনাথপ্রদত্ত প্রকৃত সুর এখন আর জানার উপায় আছে বলে মনে হয় না।
গানটির দ্বিতীয় অন্তরা (‘খুলি মোর গৃহদ্বার’) উক্ত গ্রামোফোন রেকর্ডে গীত হয়নি। কিন্তু স্বরবিতানে উল্লিখিত হয়েছে।
এর মূল গানের কথা ও সুর অনন্তলাল গঙ্গোপাধ্যায়কৃত (‘কহে ন তুম জাবেত’)। এটি পাওয়া যাবে অমলকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথঃ নির্বাচিত রাগসঙ্গীত’ গ্রন্থে।
সৌভাগ্যক্রমে মায়া সেন আমাদের গানটি তালে শিখিয়েছিলেন, যা প্রমাণ করে যে তাঁর ছাত্রাবস্থায় শান্তিনিকেতনে গানটি তালেই গাওয়া হত। এর ক্লাস রেকর্ড নেই।
এতৎসত্ত্বেও কীভাবে ও কেন মুক্তছন্দে গায়নের রীতি প্রবর্তিত হল, সে বিষয়ে বিস্ময়প্রকাশ করেছেন সুভাষ চৌধুরী। এর দুটি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে -
ক। আদি গুরুদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের কাছে সেভাবেই শিখেছিলেন, যা শান্তিনিকেতনে অথবা কলকাতায় তাঁদের শিষ্যবর্গের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
খ। শান্তিনিকেতনের কোনো গুরু স্বাধীনভাবে এই ঐতিহ্য তৈরি করেন, যা ছাত্রছাত্রীরা বহন করে চলেছেন।
যতদূর খোঁজ করতে পেরেছি, মুক্তছন্দে প্রথম রেকর্ড করেন মোহরদি। সম্ভবতঃ সেখান থেকেই স্বরলিপি বহির্ভূত এই ঐতিহ্যের সুত্রপাত।
আমার এই গানটির প্রথম রেকর্ড মুক্তছন্দে গীত ( • Tagorean Khayal/Swopono Jodi Bhangile/Ramk... )।
ব্রহ্মসঙ্গীতটির রাধিকাপ্রসাদের রেকর্ডের প্রচ্ছদে কালীঘাটের বাবু বিবির পটের চিত্র ব্যবহৃত হয়েছে। ঠাকুরবাড়ির অন্যতম সঙ্গীতগুরু হওয়া সত্ত্বেও কলকাতায় সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের সঙ্গে সম্পর্ক পরিত্যাগ করা বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পীদের পক্ষে তখনও মূলতঃ সম্ভব ছিল না। উল্লেখ্য, রেকর্ডটি প্রকাশিত হওয়ার দু'বছর পর বর্ধমান মহারাজার সভাগায়ক ও বিষ্ণুপুর ঘরানার অপর স্তম্ভ গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৫৯০ পাতার গ্রন্থ সঙ্গীতচন্দ্রিকা (দ্বিতীয় খণ্ড) প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে কবির গান একটি, যদিও মহারাজা মহতাবচাঁদের গান চারটি।
কিন্তু শান্তিনিকেতনের পরিমণ্ডলে রেনেসাঁধর্মী আধুনিকতা এর বিপরীত আবহাওয়া তৈরি করে এবং সেখানে গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অশেষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রগানের অন্যতম ধারকে পরিণত হন। রবীন্দ্রগানের এইভাবে ক্রমশ আধুনিক হয়ে ওঠা এর অন্তর্লীন শক্তি।
মাঘোৎসবের মাত্র সাতান্ন দিন পূর্বে মৃণালিনীদেবীর অকালমৃত্যুজনিত (২৯/১১/১৯০২) সন্তাপ এই গানে ধ্বনিত হয়েছে বলে প্রশান্তকুমার পাল মনে করেন (রবিজীবনী, পঞ্চম খণ্ড, পৃ ৬)। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা, ভিন্ন কোনো ধ্রুব সত্য অনুধাবনে কবিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এইভাবে আলোচ্য ব্রহ্মসঙ্গীতটির জন্ম।
No infringement of copyright intended.
Информация по комментариям в разработке