বাংলা ভাষার প্রমিতকরণ ও উপনিবেশায়ন (দ্বিতীয় পর্ব)। মোহাম্মদ অাজম
বইটি ‘উপনিবেশ আমলে লেখ্য-বাংলার রূপ ও রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষাচিন্তা’ শীর্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পি.এইচ.ডি অভিসন্ধর্ভের মুদ্রিত রূপ। ৮টি অধ্যায় আছে এই বইয়ে। প্রথম অধ্যায় হচ্ছে ভূমিকা। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশায়নের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা। তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয়বস্তু বাংলা ভাষার বিবর্তনের উপর উপরোক্ত উপনিবেশায়নের প্রভাব। চতুর্থ অধ্যায়ে উনিশ শতকে বাংলা গদ্য ও বাংলা ভাষাচর্চার একাধিক ধারার বর্ণনা আছে। বাংলা ভাষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা আসলে কী ছিল সেটা বলা হয়েছে পঞ্চম অধ্যায়ে। বাংলা ভাষা বর্ণনার সূত্র ও প্রণালি-পদ্ধতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতামত ষষ্ঠ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়। সপ্তম অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, বানান ইত্যাদি সম্পর্কে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমূখ তথাকথিত ‘নব্য ব্যাকরণবিদ’ এবং রবীন্দ্রনাথের মতামত। অষ্টম অধ্যায়ে বাংলা ভাষা, বানান ও ব্যাকরণসংক্রান্ত একাধিক বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতামতের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
‘What you think or believe does not matter, what really matters, is the matter of the fact and the fact of the matter’ (শিশির ভট্টাচার্য্য, কথাকলি, ২০১৩: ১৩৬)
‘উপনিবেশায়ন’ বলতে কী বোঝায়? মোহাম্মদ বলেছেন (পৃষ্ঠা:১৬):
‘উপনিবেশ হলো দখলকৃত ভূমি ও সম্পদ। দখলে আনা ভূমি, সম্পদ ও জনগোষ্ঠীর উপর সার্বিক আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়াই উপনিবেশায়ন।’ (পৃষ্ঠা:১৫) ইংরেজদের আগে আর্য্য-তুর্ক-পাঠান-মোগল বাংলা অঞ্চলের দখল নিয়েছে বটে, কিন্তু ইংরেজের উপনিবেশ ছিল একেবারেই ভিন্নরকম একটি সমাজ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি ‘কেবল সম্পদ আর পণ্য লুটে নেয়নি, উপনিবেশিত রাষ্ট্রের পুরো অর্থনৈতিক সম্পর্ককেও বদলে দিয়েছে। দাস ও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক আর কাঁচামাল গেছে কেন্দ্রে, উপনিবেশগুলো হয়ে উঠেছে উপনিবেশের এক একটি বাজার…কেন্দ্রই হয়েছে মুনাফার ভাগিদার।’
লেখক তাঁর পুস্তকে রেফারেন্স দেবার ক্ষেত্রে যে রীতি অনুসরণ করেছেন তাতে তাঁকে ‘আজম’ না বলে ‘মোহাম্মদ’ নামে ডাকতে হয়। বাংলায় লিখেছেন এমন লেখকদের পারিবারিক নাম ব্যবহার না করে নামের পূর্বাংশ ব্যবহার করেছেন তিনি: ‘চট্টোপাধ্যায়’ নয়, ‘বঙ্কিম’; ‘ঠাকুর’ নয়, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘দেবেন্দ্রনাথ’ ইত্যাদি। ইংরেজিতে লিখেছেন এমন লেখকদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন পারিবারিক নাম: David নয়, Arnold; ‘আশীষ’ নয়, ‘নন্দী’; ‘কাজী আবদুল’ নয়, ‘মান্নান’ ইত্যাদি। যাই হোক, ‘সুজনে সুজশ গায় কুযশ ঢাকিয়া!’ লেখককে আমরা ‘আজম’ নামেই ডাকবো, ঔপনিবেশিকতার কাছে মাথা আভূমি নত হয়ে যাবার ঝুঁকি নিয়েই না হয় ডাকবো।
আজমের গবেষণার মূল বিষয়বস্তু অবশ্য উপনিবেশায়ন নয়, ভাষার উপনিবেশায়ন। তিনি বলেছেন, উপনিবেশায়নের ফলে ভাষার ক্ষেত্রে তিন ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে:
১. স্থানীয় ভাষা ব্যবহারিক জগৎ থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসিত হয়ে যায়;
২. বিদ্যমান ভাষাকাঠামোর আমূল পরিবতন ঘটে;
৩. উপনিবেশিতের ভাষাকে হটিয়ে দিয়ে তার স্থান দখল করে উপনিবেশকের ভাষা।
বাংলার ক্ষেত্রে কী হয়েছে? আজমের মতে:
১.বাংলার ভাষাকাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা গদ্যের রূপ বদলে গেছে। হঠাৎ করে বাংলা গদ্যে অপ্রয়োজনে, জোর করে প্রচূর সংস্কৃত শব্দ আমদানি করা হয়েছে। সংস্কৃত শব্দমুক্ত এবং আরবি-ফারসি শব্দযুক্ত প্রচলিত, সর্বসাধারণবোধ্য সরল গদ্যরীতিকে গ্রহণ না করে একটি কৃত্রিম রীতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। আজমের দাবি, ঔপনিবেশিক প্রভুর ইঙ্গিতে সংস্কৃত প-িতেরা এই অপকর্মটি করেছেন। এটি অপকর্ম, কারণ এর ফলে বাংলা গদ্য তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও গতি হারিয়ে ফেলেছিল এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
২. অবশেষে বাংলাকে হটিয়ে দিয়ে তার স্থান দখল করেছিল ইংরেজি।
অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু হয়ে ও ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন চলেছে। ঊনবিংশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে বাংলা গদ্যের উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার বিরোধিতার প্রক্রিয়ার শুরু। আজমের মতে, বিরোধিতাকারীদের মধ্যে প্রধানতম ব্যক্তি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৮৫ থেকে শুরু করে ১৯৪১ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিভিন্ন রচনায় তিনি বাংলা ভাষার উপনিবেশায়নের বিরোধিতা করেছেন। কী ছিল তাঁর দাবি?
১. উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হোক,
২. বাংলা ব্যাকরণকে সংস্কৃতের প্রভাবমুক্ত হোক,
৩. প্রকৃত (বা প্রাকৃত) বাংলা ব্যাকরণ রচিত হোক এবং
৪. বাংলা বানান বাংলা ভাষার উচ্চারনানুগ হোক।
এবার আমরা আজমের দাবিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখবো। কাকে বলে ‘বাংলা ভাষা’? মান/চলিত বাংলা, নাকি বাংলা অঞ্চলে ব্যবহৃত সবগুলো উপভাষার সমষ্ঠি? আজমের গবেষণার বিষয়বস্তু কি বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন, নাকি নিছকই বাংলা গদ্যরীতির উপনিবেশায়ন? আজম বলেছেন (পৃষ্ঠা ৩০) ‘ঔপনিবেশিক শাসনের প্রত্যক্ষতায় গড়ে ওঠা বাস্তবতা বাংলাভাষা, বিশেষত বাংলা গদ্যের, পরিবর্তিত রূপের গড়ন ও চর্চার ধরনে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্টা করেছে’ তার বিশ্লেষণ করেছেন তিনি আলোচ্য গ্রন্থে। আজম জানিয়েছেন, লিখনরীতি তাঁর অভিসন্ধর্ভের বিষয়বস্তু নয়।
সাহিত্য-বহির্ভূত রচনার ভাষা, শিক্ষা ও অফিস-আদালতে নিত্য-ব্যবহার্য ভাষা লিখিত আকারে যেভাবে গঠিত ও ব্যবহৃত হয়, তাই মূল বিবেচ্য। অর্থাৎ ‘মান বা প্রমিত বাংলা থেকে লেখ্য বাংলাকে আলাদা ধরা হয়নি এই অভিসন্ধর্ভে।
আমাদের আপত্তি: কথ্য মান বাংলা আর লেখ্য বাংলা দুটি আলাদা ‘উপভাষা’। এ দুটিকে এক করে দেখাটা ভাষাতত্ত্ব অনুমোদন করে না। অনুমোদন না করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ও কারণ রয়েছে এবং সেই কারণ আর যুক্তিগুলো এতই সুপ্রতিষ্ঠিত যে ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় সেগুলোর উল্লেখ করাটা পর্যন্ত বাহুল্যের পর্যায়ে পড়ে।
Информация по комментариям в разработке