৭০-এর দশকে জর্জদা (৩০) – ত্রিংশতিতম পর্ব
‘সত্তরের দশকে জর্জদা’-র ত্রিংশতিতম পর্বে দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে চারটি অপ্রকাশিত রবিগান উপস্থাপিত করলাম, দেবব্রত বিশ্বাসের স্নেহধন্য, পিতৃপ্রতিম শ্রী অধীপ চৌধুরীর সংগ্রহ থেকে। কথাপ্রসঙ্গে অধীপ বাবু আমাকে বলেছিলেন তাঁর সংগ্রহে থাকা একটি spool-এর কথা। বলেছিলেন ওঁর বাবা নবেন্দু চৌধুরীর লেখা একটি গান, ‘চরণে তোমার দাও মোরে ঠাঁই’, দেবব্রত বিশ্বাস সুরারোপ করে সেই spool-এ রেকর্ড করে দেওয়ার পর, উক্ত spool-এ বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন। অধীপ বাবুর ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা দেবব্রত বিশ্বাস গীত ত্রিশতাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত পরবর্তীকালে digitise করে সিডিতে convert করা হলেও এই spool-টি করা হয়ে ওঠে নি। কিছুকাল আগে ওঁর বাড়ীতে একটি এটাচি কেস খুলে দেবব্রত বিশ্বাস সংক্রান্ত ওনার যাবতীয় প্রাইভেট রেকর্ডিং উনি আমাকে দেন এবং সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে এ যাবৎ অশ্রুত সেই হারানিধি ! সত্যি কথা বলতে কি, ওইরকম থরে থরে রাখা, সযত্নে ক্যাটালগ করা, দেবব্রত বিশ্বাসের ক্যাসেট দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ! তারপর সে সব বাড়ীতে নিয়ে এসে digitise করতে বসে লক্ষ্য করলাম ওনার সংগ্রহের বহু গান প্রকাশিত হলেও এখনও বেশ কিছু রেকর্ডিং সর্বজনসমক্ষে আসেনি। কিছু ক্ষেত্রে অতি সক্রিয় রেকর্ডিং কোম্পানি সিডি প্রকাশ কালে গানের যে seriality দেবব্রত বিশ্বাস বিশেষ কারণ বশত সৃষ্টি করেছিলেন, সেটি অগ্রাহ্য করেছেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে গানের আগে দেবব্রত বিশ্বাসের বলা কথা বা তথ্য বাতিল করে দিয়েছেন। এ কাজটি তাঁরা হয়ত তাঁদের ব্যবসায়িক কারণে করে থাকবেন, কিন্তু যারা দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গীতবোধ, রাবীন্দ্রিক সত্ত্বা এবং গায়নযুক্তির খোঁজ করে চলেছেন অবিরত, গায়ক দেবব্রত বিশ্বাসকে ছাপিয়ে মরমী মানুষ দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে পৌঁছবার চেষ্টা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত, তাঁরা যে এই ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া জাত কারণে রসগ্রহণে কিছুটা হলেও বঞ্চিত হবেন, তা বলাই বাহুল্য। তাই ভবিষ্যতের জর্জ-ভক্ত এবং যারা ওঁর গান নিয়ে গবেষণা করতে এগিয়ে আসবেন, তাঁদের জন্য রসদ রাখা রইলো আমার এই ইউটিউব চ্যানেলে। এই চ্যানেলে দেবব্রত বিশ্বাসের অশ্রুত, স্বল্প শ্রুত এবং অপ্রকাশিত গানই শুধু নয় তাঁর নিজ মুখ নিঃসৃত সঙ্গীতভাবনা এবং গায়নযুক্তিরও উচ্চারিত এবং অনুচ্চারিত আভাস ধরা রইলো সব শ্রেণীর দেবব্রত ভক্তদের জন্য।
আজকের আপলোড করা চারটি গান কোনও সিডি বা ক্যাসেটে প্রকাশিত হয়নি। দেবব্রত বিশ্বাস যে এক বসায় টানা গেয়েছিলেন গানগুলি, তা রেকর্ডিং শুনলে আপনারা সহজেই বুঝতে পারবেন। আপনারা রসজ্ঞ শ্রোতা - এই চারটি গান পর পর শুনে দুটো ব্যাপার খুব সহজেই আপনাদের নজরে আসবে। প্রথমত, এই চারটি গানে একটি শব্দ যেটি ঘুরে ফিরে এসেছে তা হল ‘গান’ কথাটি। আরও বিশেষ ভাবে বলতে গেলে দেবব্রত বিশ্বাস যেন তাঁর ‘আপন গান’-এর সংজ্ঞা তাঁর শ্রোতাদের কাছে ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন গানের মাধ্যমে। ‘যায় নিয়ে যায় আমায় আপন গানের টানে’-র থেকে চলে গেছেন ‘কেন তোমরা আমায় ডাকো, আমার মন না মানে, পাই নে সময় গানে গানে’-তে। তার পরমুহূর্তেই গেয়ে উঠেছেন, ‘আমার মনের মাঝে যে গান বাজে শুনতে কি পাও গো’ এবং শেষ করেছেন, ‘আমি যে গান গাই জানি নে সে কার উদ্দেশে’ দিয়ে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এখানে সংবেদনশীল সম-মনস্ক শ্রোতার সঙ্গে শিল্পীর একটি কথোপকথন হচ্ছে, যেখানে গায়ক তাঁর না বলা বাণী, না বলা বেদনা রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় ব্যক্ত করছেন তাঁর প্রিয় ভক্তদের কাছে। অনুভূতিপ্রবণ শ্রোতৃবৃন্দের সঙ্গে এই জাতীয় communication জর্জ বিশ্বাস বহুবার করেছেন। ‘কিংশুক’ প্রদত্ত সম্বর্ধনা সভাতে দেবব্রত বিশ্বাসের গানের নির্বাচনও সেই সাক্ষ্যই দেয়।
বহু সমালোচক তাঁকে নিঃসঙ্গ অভিমানী এক শিল্পী বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি নিজে বলেছেন – অভিমান নয়, বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অযৌক্তিক মধ্যযুগীয় একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং সেই কারণেই ১৯৭০ থেকে আর রেকর্ডিং করেন নি। কিন্তু কোথাও যে একটি অব্যক্ত যন্ত্রণা তাঁর মধ্যে কাজ করছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং হয়ত কিছুটা অভিমানও। যার প্রতিফলন ঘটে ফিরে ফিরে গাওয়া ‘দাও না ছুটি, ধর ত্রুটি, নিই নে কানে, মন ভেসে যায় গানে গানে’-র মধ্য দিয়ে। এ নির্মম সত্য আপনারা সকলেই জানেন যে এই অসম লড়াইয়ে দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন সর্বতোভাবে একা – তাঁর পাশে তাঁর শ্রদ্ধেয় সমসাময়িকরা বা তাঁর কাছের মানুষরা কেউই দাঁড়ান নি। মনে মনে সমর্থন থাকলেও, পেশাগত কারণে তাঁরা কেউ সোচ্চার হন নি বা হওয়ার সাহস দেখাতে পারেন নি। যারা আজকাল মঞ্চ খাটিয়ে স্মরণ-মরণ কমিটি করে ঘটি ঘটি কুম্ভীরাশ্রু ফেলেন তারাও সেদিন পাশে ছিলেন না। তবুও রেকর্ডে ধৃত কিছু কথোপকথনে আজ আমরা জানতে পারি যে দেবব্রত বিশ্বাস মনে মনে আশা করেছিলেন যে সব মহারথীবৃন্দ বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের হর্তাকর্তাবিধাতা ছিলেন, তাঁরা শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে মিটমাট করে নেবেন এবং শেষ জীবনে তিনি আরও কিছু গান রেকর্ড করে যেতে পারবেন। এই হর্তাকর্তাবিধাতা-দের মধ্যে একজনকে তিনি বিশেষ স্নেহ করতেন – তাঁর IPTA জীবনের নিকট সঙ্গী – যার সঙ্গে মাঠে, ঘাটে, বন্দরে, কল-কারখানায় বহু সাম্যবাদের গান, রবীন্দ্রনাথের গান তিনি একদা গেয়েছেন। মনে ক্ষীণ আশা ছিল তিনি হয়ত দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গীত-চিন্তার সমাদর করে সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। কিন্তু সে আশা যখন অচিরেই অলীক স্বপ্নে পর্যবসিত হল তখন ওঁর মন ভেঙে গিয়েছিল – সঙ্গে সঙ্গে শরীরও। তাই শেষ বয়সে তাঁকে যন্ত্রণাক্লিষ্ট স্বরে গাইতে হল-
‘ক্যারে হেরায় আমারে গাইতায় দিল না – আমি বুঝতাম পারলাম না
এই কথাটা তো ব্যাবাকের আছে জানা
জাইন্যা-হুন্যাও কেউ কিছু রা-ও কাড়ে না
ক্যারে হেরায় আমারে গাইতায় দিল না – আমি বুঝতাম পারলাম না’
নমস্কারান্তে,
জয়ন্তানুজ ঘোষ
৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
Информация по комментариям в разработке